একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে জয়পুরহাট সদর থানায় করা মামলায় দুই মাদ্রাসাশিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীর বাবা বাদী হয়ে জয়পুরহাট সদর থানায় মামলা করেন। এরপর পুলিশ অভিযান চালিয়ে জয়পুরহাট জেলার বুজরুগ ভারুনিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। এরপর বিকেলে আদালতের মাধ্যমে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত দুই শিক্ষক হলেন, সদর উপজেলার বুজরুক ভারুনিয়া দাখিল মাদ্রাসার কারি শিক্ষক রেজাউল করিম (৫৫) ও ইবতেদায়ী মওলানা তহিদুল ইসলাম।
মামলার বিবরণে জানা গেছে, গত ২৩ আগস্ট জয়পুরহাট সদর থানার দোগাছী ইউনিয়নের তেতুলতলী এলাকার বুজরুক ভারুনিয়া দাখিল মাদ্রাসায় প্রতিদিনের মতো ওই ছাত্রী ক্লাস করতে যায়। ক্লাসের সময় শিক্ষক রেজাউল করিম অন্য ছাত্রছাত্রীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওই ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করে। পরে ইবতেদায়ী মওলানা তহিদুল ইসলামও তার সঙ্গে একই ঘটনা ঘটায়।
এরপর ওই ছাত্রী বাড়ি এসে তার মাকে বিষয়টি খুলে বলে। এদিকে অভিযোগ পেয়ে পুলিশ বৃহস্পতিবার দুপুরে দুই জনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। পরে থানায় মামলা হলে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিকেলে আদালতে পাঠানো হয়।
ভুক্তভোগী, এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত শিক্ষকেরা দীর্ঘ দিন যাবৎ ওই মাদ্রাসার একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানিসহ নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে রেজাউল করিম ৩য় শ্রেণির এক ছাত্রীর (১০) বুকে হাত দেন। বাড়ি গিয়ে ওই ছাত্রী তার বাবা-মাকে বিষয়টি জানায়।
অন্যদিকে ওই মাদ্রাসার ইবতেদায়ি শাখার জুনিয়র শিক্ষক তৌহিদুল ইসলামের (৩৫) বিরুদ্ধেও একাধিক ভুক্তভোগীর অভিভাবক অভিযোগ তুলেছেন।
বুধবার রাতে ওই ছাত্রীর বাবা অ্যাডহক কমিটিতে অভিযোগ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে অ্যাডহক কমিটি জরুরি মিটিং করে অভিযুক্ত শিক্ষকদের ছয় মাসের জন্য সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মিটিং চলাকালে গ্রামের লোকজন অভিযুক্ত শিক্ষক তৌহিদুল ইসলামকে মারধর শুরু করেন। প্রায় আধঘণ্টা পর পরিস্থিতি শান্ত হলে মাদ্রাসার দ্বিতীয় তলায় আবার বৈঠক বসা হয়। সেখানে গ্রামের লোকেরা অভিযুক্ত শিক্ষক রেজাউল করিমকেও মারধর করেন। এতে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গ্রামের লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তখন ফোনে ইউএনওকে ঘটনাটি জানানো হয়। পরে দুপুরে পুলিশ এসে মাদ্রাসা থেকে দুই শিক্ষককে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এরপর শিশুটির বাবা বাদী হয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে আটক দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
ওই ছাত্রীর বাবা ও একাধিক অভিভাবক জানান, শিক্ষক রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে একই অভিযোগে এর আগে তিন মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও তিনি শোধরাননি।
বুজরুগ ভারুনিয়া দাখিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্তেই অভিযুক্ত দুজন শিক্ষকে ছয় মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পরে যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে জয়পুরহাট সদর থানার ওসি একেএম আলমগীর জাহান জানান, এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থীর বাবা বৃহস্পতিবার দুপুরে বাদী হয়ে জয়পুরহাট সদর থানায় মামলা করেন। এর পরপরই অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিকেলে আদালতের মাধ্যমে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না। কওমি, এবতেদায়ী বা নূরানী-বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ