তরুণ প্রজন্মদের মধ্যে যারা মাদকাসক্ত তাদের জন্য চাকরির দরজা বন্ধ হচ্ছে। সেজন্য ‘ডোপ টেস্ট বিধিমালা-২০২১’ হতে যাচ্ছে। এখন থেকে সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগে প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট বা মাদক পরীক্ষা করতে হবে। যার পরীক্ষার ফলাফল নেতিবাচক হবে, তিনি চাকরির জন্য অযোগ্য বিবেচিত হবেন। এমনকি হতে পারে জেল-জরিমানাও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘ডোপ টেস্ট বিধিমালা-২০২১’ সংক্রান্ত খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং শেষে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে গেজেট আকারে বিধিমালা প্রকাশিত হবে।
প্রসঙ্গত, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ (সংশোধিত ২০২০) এর আলোকে এই বিধিমালা প্রণীত হচ্ছে।
বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট করা হবে। এছাড়া চাকরিরত অবস্থায় কেউ মাদক সেবন করেছেন বলে সন্দেহ হলেও তাকে টেস্টের আওতায় আনা যাবে।
খসড়া বিধিমালায় ডোপ টেস্ট রিপোর্টের নেগেটিভ এবং পজিটিভের সংজ্ঞা, নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতি, নমুনার ধরন, ল্যাবরেটরি এবং জনবল সংক্রান্ত বিষয়গুলো বিশদ আকারে ব্যাখ্যা করা হয়। এতে বলা হয়, ডোপ টেস্ট রিপোর্ট ‘পজিটিভ’র অর্থ হচ্ছে মানব দেহে জৈবিক নমুনা পরীক্ষা করে মাদকদ্রব্যের উপস্থিতি পাওয়া। ‘নেগেটিভ’র অর্থ মাদকের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি অধিদফতরের নিজস্ব পরীক্ষাগারে ডোপ টেস্ট করাতে পারবেন বলে জানা গেছে।
বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট করা হবে। এছাড়া চাকরিরত অবস্থায় কেউ মাদক সেবন করেছেন বলে সন্দেহ হলেও তাকে টেস্টের আওতায় আনা যাবে।
চাকরি ছাড়াও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের ক্ষেত্রে, কর্মরত অবস্থায় গাড়ি চালকদের বিরুদ্ধে মাদক সেবনের সন্দেহ এবং সরকারি-বেসরকারি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কারও বিরুদ্ধে মাদক গ্রহণের সন্দেহ হলে ডোপ টেস্ট করা যাবে। এমনকি বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের ক্ষেত্রে এবং আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের ক্ষেত্রেও ডোপ টেস্টের দরকার হবে। তবে এর বাইরেও সরকার নির্বাহী আদেশে ডোপ টেস্টের নতুন ক্ষেত্র নির্ধারণ করতে পারবে।
খসড়া অনুযায়ী, ডোপ টেস্টে পজিটিভ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মাদকাসক্ত ঘোষণা করা যাবে। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের রিপোর্ট পজিটিভ হলে নেওয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারি আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে।
জানা গেছে, ডোপ টেস্টের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হবে। জৈব নমুনা হিসাবে মূত্র, নখ, প্রশ্বাসের বাতাস, রক্ত, ঘাম, মুখের লালা এবং যে কোনো অঙ্গ বা অংশবিশেষ বা তরল সংগ্রহ করা হবে। নমুনার অবশিষ্টাংশ অন্তত ছয় মাস সংরক্ষণ করা হবে। এজন্য ফি নির্ধারণ করবে সরকার।
বিধিমালার খসড়ায় ল্যাবরেটরি স্থাপন সংক্রান্ত পরিচ্ছেদে বলা হয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের আওতায় এক বা একাধিক বিশেষায়িত ডোপ টেস্টিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা যাবে। এ জন্য পরীক্ষকসহ প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ করবে নারকোটিক্স। ডোপ টেস্টের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মাদক যেমন-অপিয়স (হোরোইন, মরফিন, কোডিন), মেথমফিটামিন (ইয়াবা), ক্যানাবিয়ডস (গাঁজা, ভ্যাং, মারিজুয়ানা, হাশিশ) ও বেঞ্জোডায়াজিপাইন (ডায়াজিপাম, ক্লোনাজিপাম, মিডাজোলাম) সংক্রান্ত আসক্তি নির্ধারণ করা হবে।
এমনকি মদ (ইথাইল অ্যালকোহল) পানে অভ্যস্ত ব্যক্তিদেরও আসক্তি ধরা পড়বে ডোপ টেস্টে। ডোপ টেস্ট সংক্রান্ত আবেদনে নমুনা প্রদানকারীকে নাম, পিতার নামসহ ১৯ ধরনের তথ্য দিতে হবে।
প্রস্তাবনায় এ বিষয়ে ৯ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির কথা বলা হয়েছে। কমিটির প্রধান হবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়া স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ প্রধান, বিজিবি মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকরাও থাকবেন কমিটিতে।
টেস্টের পদ্ধতি, ল্যাবরেটরি, পরীক্ষা পদ্ধতির মানদণ্ড বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরেকটি টেকনিক্যাল কমিটি থাকবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) এর যার প্রধান হবেন।
২০১৮ সালে সব শ্রেণির সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে ‘ডোপ টেস্ট’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সুরক্ষা সেবা বিভাগ ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সব মন্ত্রণালয়/বিভাগে চিঠি দেয়। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসার আগে ডোপ টেস্ট/বিশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগকে চিঠি দিয়েছে। সেই চিঠির বাস্তবায়ন অগ্রগতি না পাওয়ায় গত বছরের ২০ আগস্ট সংশ্লিষ্ট বিভাগে তাগিদপত্র দেয়া হয়। তবে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ গত ২৪ জুন তাদের আওতাধীন দপ্তরগুলোয় ওই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
ইতোমধ্যেই ভর্তি প্রক্রিয়ায় ডোপ টেস্ট চালু করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তারা শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়ায় ডোপ টেস্টের শর্ত জুড়ে দিয়েছে এবং সেই সিদ্ধান্তের আলোকে ভর্তি চলছে।
এদিকে দেশব্যাপী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরও গতিশীল ও জোরদার করার লক্ষ্যে ৬২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন বছরমেয়াদি ‘মাদকাসক্ত শনাক্তকরণ ও ডোপ টেস্ট প্রবর্তন (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি ১৯ টি জেলায় বাস্তবায়ন হবে। জেলাগুলো হচ্ছে- ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাঙামাটি, নোয়াখালী, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, পটুয়াখালী, সিলেট, রংপুর ও দিনাজপুর।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়ার আগে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়। এর পর থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন শাখায় সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চাকরি প্রত্যাশীদের ডোপ টেস্টের জন্য তালিকা পাঠানো হচ্ছে।
এই ডোপ টেস্টে মুখের লালা পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ ৭ দিন, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ দুই মাস, চুল পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ ১২ মাস এবং স্প্যাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষার মাধ্যমে গত পাঁচ বছরের মধ্যে কেউ মাদক গ্রহণ করলেও তা ধরা পড়বে। কিন্তু বর্তমানে শুধু মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে কেউ শেষ ১০ দিনের ভেতর কোনো মাদক গ্রহণ করেছেন কিনা তা ধরা পড়ে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে নতুন মাদকের আগ্রাসন অন্যদিকে বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যক্তিদের মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলছে। ইয়াবা নামক মরণ নেশার হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন মাদক বিরোধী সর্বাত্মক সামাজিক সচেতনতা ও সকল বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ অভিযান। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সীমিত জনবল ও লজিস্টিকস দিয়ে অধিদফতরের পক্ষে মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন রোধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত প্রয়াস।
তারা বলেন, এটা প্রমাণিত যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ভ্রাম্যমাণ আদালতের ঝটিকা বিচারের মতো পদক্ষেপগুলো আমাদের মাদকের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিচ্ছে না। সরকারকে অবশ্যই সর্বাত্মক মাদকবিরোধী অভিযানে নিয়মিতভাবে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। এটা সময়ে সময়ে বা অ্যাডহক ভিত্তিতে করলে সেটা আত্মঘাতী হবে।
তারা বলেন, পুলিশ বিভাগ যেভাবে ডোপ টেস্ট ব্যবস্থা চালু করেছে, সেটা অবিলম্বে কীভাবে সম্প্রসারণ করা যায়, সেই বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই যথা পদক্ষেপ নিতে হবে। পুলিশের যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে, সেটা যেন কোনোভাবেই থমকে না যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ