পুলিশের সোর্স ও পুলিশ চক্রান্ত করে বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী গ্রামের বাসিন্দা বাদল মিয়াকে(৫৭) মিথ্যা মামলায় ৩৫ দিন কারাভোগ করানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ এনেছেন ভোক্তভোগী নিজে। আজ বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ তুলে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, শুধুমাত্র টাকার জন্য ভুয়া একটি গ্রেফতারি পরোয়ানায় পুলিশের সোর্স সাইফুল ও ইলিয়াস বরগুনা থানায় কর্মরত এএসআই নাঈমুর রহমান ও সাইফুল ইসলাম ষড়যন্ত্র করে আমাকে ঘৃণ্য অপরাধের মিথ্যা অভিযোগে ৩৫ দিন কারাভোগ করিয়েছে। তাই আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় দালাল সাইফুল এবং ইলিয়াস ষড়যন্ত্র করে তাকে ফাঁসিয়েছে। তিনি বলেন, প্রথম আমাকে পুলিশ যেদিন গ্রেফতার করে তারপর ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনে আমাকে সাইফুলদের বাড়িতে ৪ দিন আটকিয়ে রাখে। আমার মনে হয় আমার ক্ষতি করার জন্য পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে সাইফুল ও ইলিয়াস এই ভুয়া ওয়ারেন্ট বানিয়ে আমাকে আটক করায়। আমি জীবনে কখনও ঢাকা যাইনি অথচ সেই ঢাকারই একটি শিশু ধর্ষণ মামলায় আমাকে ৩৫ দিন জেল খাটতে হয়েছে। যারা আমার সাথে প্রতারণা করে আমাকে জেল খাটিয়েছে আমি সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
বাংলা ট্রিবিউন সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর বরগুনার সদর থানা পুলিশের এএসআই সাইফুল ইসলাম ঢাকার শিশু আদালতের ৯(১) ধারায় দায়ের করা শিশু ধর্ষণ মামলায় একটি ওয়ারেন্টের বলে বাদল মিয়াকে গ্রেফতার করেন। থানায় স্থানীয় পুলিশের সোর্স ইলিয়াস ও সাইফুলের মাধ্যমে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে ছাড়িয়ে নেয় বাদলের স্বজনরা। এর অল্প কিছুদিন পর ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ পুনরায় একই মামলার ওয়ারেন্টে বরগুনার সদর থানার আরেক এএসআই নাইমুর আবারও গ্রেফতার করেন বাদল মিয়াকে। এ পর্যায়ে কোনও মীমাংসা না হলে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠায় পুলিশ। এরপর বাদল মিয়ার ছেলে বাবাকে মুক্ত করার জন্য ঢাকা গিয়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেন। খোঁজ খবর নিয়ে তিনি জানতে পারেন ঢাকা জজ কোর্টে শিশু আদালত বলতে কোনও আদালত নেই। সেখানে নয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে যেগুলো শিশু আদালত হিসেবে কাজ করে। এর কোনও আদালতেই বাদল মিয়ার বিরুদ্ধে যে ওয়ারেন্টের কাগজ দেখানো হয়েছে সেই মামলার উল্লেখ নেই। ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু আদালতে তন্ন তন্ করে খুঁজেও মামলাটির কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পরে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতের বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে আদালতের বিচারক বিষয়টি আমলে নিয়ে বাদল মিয়াকে মুক্তি দেন।
বাদল মিয়ার ছেলে রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, আমার বাবাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ভুয়া ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পুলিশ ও স্থানীয় দালাল যৌথভাবে আমার বাবাকে হেয় প্রতিপন্ন ও আমাদের ছোট করার জন্যই এ কাজ করেছিল। আমার বাবাকে গ্রেফতার করার পর আমি নিজে ঢাকার সকল শিশু আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে এই ধরনের কোনও মামলার অস্তিত্ব পাইনি। প্রত্যেকটা আদালতের সার্চিং স্লিপ আমরা উত্তোলন করে এনেছি। আমার বাবাকে যারা ফাঁসিয়ে ভুয়া ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করিয়েছে তাদের খুঁজে বের করে আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।
একইসঙ্গে একটি ভুয়া ওয়ারেন্ট দেখিয়ে একই ব্যক্তিকে পুলিশের দুজন এএসআই কীভাবে ধরে নিয়ে যায় বা ছেড়ে দিতে পারে সে বিষয়টিও বিবেচনার দাবি রাখে। আদালতের এবং পুলিশ প্রশাসনের উচিত বিষয়টি তদন্ত করে এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা এবং তাদের সোর্সদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
মামলার ওয়ারেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওয়ারেন্টে মামলা নম্বর হিসেবে লেখা হয়েছে জি.আর ৪২৫/১৭ ও শিশু-৮৯০/১৮ এছাড়াও অপরাধ হিসেবে লেখা হয়েছে শুধু ৯(১) ধারা। পাশাপাশি মামলা নম্বরে ২০১৭ সাল উল্লেখ থাকলেও বিচারকের স্বাক্ষরের স্থলে তারিখ দেওয়া হয়েছে ০৪/০৪/১৪। মামলা ২০১৭ সালের হলেও ওয়ারেন্টে ২০১৪ সালের বিচারকের স্বাক্ষর বিশ্বাসযোগ্য নয়। এছাড়াও ওয়ারেন্টে আদালতের সিল থাকার কথা থাকলেও এই ওয়ারেন্টে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিল রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দাখিলকৃত ওয়ারেন্টটি ভুয়া বলে ধারণা করা হয়।
তবে একটি ভুয়া ওয়ারেন্টে দ্বিতীয়বার একই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেও অনুশোচনা নেই বরগুনা থানায় কর্মরত এএসআই নাঈমুর রহমানের। তার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন তার থানার ওসিও।
এ বিষয়ে বরগুনা থানায় কর্মরত এএসআই নাঈমুর রহমান বলেন, ‘বাদল মিয়ার গ্রেফতারি পরোয়ানা বরগুনা থানায় এসেছে ২০১৮ সালে। তখন আমি পিরোজপুরে কর্মরত ছিলাম। আমি বরগুনা থানায় যোগদান করেছি গত বছরের ৬ নভেম্বর। সে হিসেবে আমি যোগদান করার দুই বছর আগেই বরগুনা থানায় বাদল মিয়ার গ্রেফতারি পরোয়ানা আসে। তাই আদালতের আদেশ অনুযায়ী বাদল মিয়াকে গ্রেফতার করে আমি আইনানুগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করি।
তিনি আরও বলেন, বাদল মিয়া নিভৃত গ্রামের একজন মানুষ। তিনি বা তার পরিবারের কারও সঙ্গেই আমার কোনোরকম পরিচয় কিংবা যোগাযোগ ছিল না। শুধু গ্রেফতারের জন্যই তাকে আমি খুঁজেছি। এখানে আমার কোনও দোষ নেই। তিনি শুধু শুধুই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছেন।
বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কেএম তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘অন্যসব গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত আসামিদের মতই বাদল মিয়াকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এখানে পুলিশের কোন দোষ নেই। কেননা সকল ক্ষেত্রে গ্রেফতারি পরোয়ানার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয় না পুলিশের। তবে পুলিশের সঙ্গে প্রতারণা করে একজন নিরাপরাধ মানুষকে হয়রানি করেছে তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্পষ্টত হয়রানির উদ্দেশ্যে বিচারব্যবস্থার নামে এমন অপব্যবহার আশঙ্কাজনক। এই অপব্যবহার রোধে আদালতের নির্দেশ অনুসারে ওই ঘটনার দ্রুত ও সুচারু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যাতে এর সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত হয়। একই সঙ্গে ভুক্তভোগীকে কয়েক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/বিটি/কেএইচ/১৯২৩
আপনার মতামত জানানঃ