
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত আবারও অগ্নিগর্ভ। দুই দেশের মধ্যে বহু বছরের টানাপোড়েন, অভিযোগ-প্রত্যাঘাত, সীমান্তে গুলিবিনিময়, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান—সবকিছু মিলিয়ে অঞ্চলটি যেন আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে। শুক্রবার পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানি সেনার একটি ঘাঁটিতে আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়। এতে কমপক্ষে ছয়জন পাকিস্তানি সেনা এবং ছয়জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এই হামলার পর সীমান্তজুড়ে আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, যদিও মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই দুই দেশের মধ্যে ৪৮ ঘণ্টার সংঘর্ষবিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উত্তর ওয়াজিরিস্তানের খাদি দুর্গ এলাকায় সকালে এক বিস্ফোরকভর্তি গাড়ি পাকিস্তানি সেনাঘাঁটির ভেতরে ঢুকে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে এবং তীব্র বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। মির আলী এলাকার পুলিশ কর্মকর্তা মেরাজ খান জানান, ‘‘নিরাপত্তা বাহিনী দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায় এবং আক্রমণকারীদের সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। এতে ছয়জন নিরাপত্তা কর্মী শহীদ হন এবং এক ডজনেরও বেশি আহত হন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘লড়াইয়ের সময় ছয়জন সন্ত্রাসীকে হত্যা করা সম্ভব হয়েছে, আর এলাকা ঘিরে অভিযান চলছে যাতে কেউ পালিয়ে যেতে না পারে।’’
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে স্থানীয় গণমাধ্যম ও নিরাপত্তা সূত্রগুলো বলছে, এটি সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাগুলোর একটি। হামলাটি এমন সময় ঘটল, যখন দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে কয়েক ডজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং শত শত আহত হয়েছে।
পাকিস্তান দাবি করছে, এই সন্ত্রাসী হামলাগুলোর পেছনে রয়েছে আফগানিস্তানের মাটি থেকে পরিচালিত তালেবান-সম্পৃক্ত সংগঠনগুলো। ইসলামাবাদ বলছে, আফগানিস্তান তার সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া পাকিস্তানি তালেবান বা টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) যোদ্ধাদের দমন করতে ব্যর্থ হচ্ছে, বরং তারা আফগান মাটিতে নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে। অপরদিকে, কাবুল এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। আফগানিস্তানের তালেবান সরকার বলছে, পাকিস্তান মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে এবং সীমান্তে সংঘাত উস্কে দিচ্ছে।
২০২১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সরে যাওয়ার পর তালেবান কাবুলের ক্ষমতা দখল করে। সেই সময় থেকেই পাকিস্তান-আফগান সম্পর্কের মধ্যে নতুন এক জটিলতা সৃষ্টি হয়। তালেবানরা অতীতে পাকিস্তানের সমর্থন পেয়েছিল, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তাদের অবস্থান অনেকটাই বদলে গেছে। আফগানিস্তানের তালেবান সরকার এখন আর পাকিস্তানের নির্দেশে কাজ করছে না। বরং, আফগান সীমান্তের ভেতরে থাকা পাকিস্তানি তালেবানরা আফগান সরকারের শিথিল অবস্থানের সুযোগ নিচ্ছে বলে ইসলামাবাদ অভিযোগ করছে।
পাকিস্তানের সরকারি গণমাধ্যম জানিয়েছে, গত দুই দিনে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী বিভিন্ন অভিযানে ৮৮ জন তালেবান যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। এসব অভিযান মূলত আফগান সীমান্তবর্তী এলাকায় চালানো হয়েছে। পাকিস্তান দাবি করেছে, এই যোদ্ধারা আফগানিস্তানের ভেতর থেকে পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল।
এদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘আফগানিস্তান থেকে ধারাবাহিকভাবে সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তান আর চুপ থাকতে পারেনি। আমরা আমাদের জনগণের রক্তের প্রতিশোধ নিয়েছি।’’ তবে তিনি একই সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানেরও আহ্বান জানিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘‘আমরা লড়াই চাই না, আমরা স্থিতিশীলতা চাই। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে রক্ষার দায়িত্ব আমরা নেবই।’’
আফগানিস্তানের তালেবান সরকার ইসলামাবাদের এই বক্তব্যকে ‘অযৌক্তিক ও উস্কানিমূলক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। কাবুলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ সমস্যা ঢাকতে আফগানিস্তানকে দোষারোপ করছে। তারা দাবি করেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিজ দেশের অস্থিতিশীলতাকে আফগান মাটিতে চালানো সংঘাতের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে।
দুই দেশের এই বিরোধ নতুন নয়। দীর্ঘ দশক ধরে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত অঞ্চল, বিশেষত খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তান, সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। এখানকার দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয়। আফগানিস্তান দাবি করে, পাকিস্তান তার মাটিতে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানোর নামে নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যা করছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের মতে, আফগানিস্তান তার মাটি থেকে পাকিস্তানবিরোধী সন্ত্রাসী হামলা রোধে ব্যর্থ।
এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সৌদি আরব ও কাতার ইতোমধ্যে দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা শুরু করেছে। তাদের লক্ষ্য, দুই দেশের সীমান্তে চলমান সংঘর্ষ বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ খোলা। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, রিয়াদ ও দোহা উভয়েই ইসলামাবাদ ও কাবুলের সঙ্গে পৃথকভাবে যোগাযোগ করছে যাতে তারা নতুন করে সংঘাতের পথে না যায়।
এই অঞ্চলের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের এই সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে, উভয় দেশের সীমান্তে সক্রিয় বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। পাকিস্তান মনে করছে, আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারা এখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর ধারাবাহিক হামলা চালাচ্ছে।
অন্যদিকে আফগানিস্তান বলছে, পাকিস্তান বারবার তাদের সীমান্তে বিমান হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। সাম্প্রতিক সংঘর্ষে বহু আফগান বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে, যা নিয়ে কাবুল তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এই সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, সীমান্তে যেভাবে সাধারণ মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ছে, তা মানবিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আফগানিস্তান ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক সংকট ও খাদ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে। এর মধ্যে নতুন করে সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হলে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।
বিশ্লেষকরা আরও মনে করছেন, এই সংঘাত শুধু সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং এটি পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। পাকিস্তান বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং জ্বালানি সংকটে ভুগছে। এমন সময়ে সীমান্তে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হওয়া দেশটির অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে মরিয়া। এই অবস্থায় সীমান্ত সংঘর্ষ তাদের ভাবমূর্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিশ্বের অনেক দেশই তালেবান সরকারের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন। এখন যদি তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধের অভিযোগ যোগ হয়, তবে আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়াও আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক সবসময়ই জটিল। ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইতিহাসে ঘনিষ্ঠ হলেও রাজনৈতিক স্বার্থের টানাপোড়েনে এই দুই দেশ কখনও একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। আফগান তালেবানরা যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, তখন পাকিস্তান তাদের গোপনে সহায়তা দিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। পাকিস্তান মনে করছে, তালেবান সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি এবং আফগান মাটিকে পাকিস্তানবিরোধী কার্যকলাপের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে।
বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটাই অনিশ্চিত। সীমান্তে এখনও টানটান উত্তেজনা, মাঝে মাঝে গুলির শব্দ, আর দু’দেশের সেনা ঘাঁটিগুলোতে চূড়ান্ত সতর্কাবস্থা। যদিও সৌদি আরব ও কাতারের উদ্যোগে যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে সেই শান্তি এখনও অধরাই।
পাকিস্তান এখন কঠিন এক সময় পার করছে—অর্থনীতি ভেঙে পড়ার পথে, রাজনীতিতে বিভাজন, আর সীমান্তে অগ্নিসংযোগ। আফগানিস্তানও তেমন ভালো অবস্থায় নেই—আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, বেকারত্ব, খাদ্য সংকট এবং সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান দেশটিকে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই দুই দেশের মধ্যে সংঘাত যদি অব্যাহত থাকে, তবে পুরো অঞ্চলের শান্তি ও উন্নয়ন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এখন প্রশ্ন একটাই—দুই প্রতিবেশী দেশ কি একে অপরের সঙ্গে আলোচনায় বসে যৌথভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে, নাকি পুরোনো শত্রুতা আরও গভীর করে নতুন এক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাবে? সময়ই বলবে, কিন্তু এই মুহূর্তে সীমান্তের বাতাসে কেবল বারুদের গন্ধ আর অজানা আশঙ্কার ভারী ছায়া।
আপনার মতামত জানানঃ