বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সবসময়ই ভেতর থেকে ও বাইরে থেকে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের যে তথ্য প্রকাশ করেছেন, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তিনি দাবি করেছেন, প্রতিবেশী ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ মদদে বিপুল পরিমাণ জাল নোট বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে, যার পরিমাণ আনুমানিক ২ লাখ কোটি টাকা। এই সংখ্যা কেবল একটি অর্থনৈতিক অঙ্ক নয়, বরং এর মাধ্যমে বোঝা যায় বাংলাদেশকে কীভাবে অস্থিতিশীল করার একটি বড় ষড়যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে চলমান।
জুলকারনাইনের বক্তব্যে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক দিক হলো, এই জাল নোট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশের মুদ্রার কাগজের মতো একই মানের কাগজ, এমনকি নিরাপত্তা সুতা, হলোগ্রাম প্রিন্ট সবকিছু এতটাই নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়েছে যে তা খালি চোখে বা ব্যাংকের প্রচলিত যাচাই মেশিনেও ধরা পড়ছে না। এ যেন এক প্রকার অদৃশ্য অস্ত্র, যা দিয়ে একদিকে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের ব্যাংকিং সিস্টেম ও অর্থনীতিকে ভেতর থেকে আঘাত হানার চেষ্টা চলছে। যদি এই তথ্য সত্যি হয়, তবে তা শুধু জালনোটের সাধারণ সমস্যা নয়, বরং একটি কৌশলগত যুদ্ধ, যেখানে অর্থনীতিকে ধ্বংস করে রাষ্ট্রকে দুর্বল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিশ্বস্ত সূত্রের বরাতে জানা গেছে, এসব জাল নোট প্রিন্ট করা হচ্ছে বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিয়ে। অর্থাৎ ভারতের নিজস্ব মুদ্রা ছাপানোর ফ্যাসিলিটি ব্যবহার করে বাংলাদেশের নোটের হুবহু অনুরূপ কাগজ ও প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, এটি কোনো সাধারণ চক্রের কাজ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গোয়েন্দা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। এসব নোট খুব কম দামে বাংলাদেশে পাচার করা হচ্ছে এবং এখানকার জালনোট কারবারিদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, যাতে করে তারা বাজারে ছড়িয়ে দিতে পারে। এভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, নাশকতা এবং অস্থিতিশীলতার জন্য অর্থায়ন করা সহজ হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা। যদি বাজারে বিপুল পরিমাণ জাল নোট প্রবাহিত হয়, তবে সবচেয়ে আগে আঘাত হানবে খুচরা ব্যবসায়ীদের ওপর। কারণ তারা নগদ লেনদেনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যদি প্রতিদিনের আয় থেকে কিছু জাল নোট হাতে পান এবং পরে তা ব্যাংকে জমা দেওয়ার সময় ধরা পড়ে, তবে তিনি শুধু অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তই হবেন না, বরং আইনি সমস্যায়ও পড়বেন। এই ভয় ও আশঙ্কা ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করবে, যা ধীরে ধীরে পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতও মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ব্যাংক যদি বিপুল পরিমাণ জাল নোট গ্রহণ করে এবং পরে সেগুলো ধরা পড়ে, তবে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে। সাধারণ মানুষ নগদ অর্থ ব্যবহারে আতঙ্কিত হবে, ফলে ডিজিটাল লেনদেন বাড়লেও নগদ অর্থনীতির উপর আস্থা ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তখন বাধ্য হয়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যা সময়, অর্থ ও শ্রম তিন দিক দিয়েই বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
জুলকারনাইনের পোস্টে আরও উল্লেখ রয়েছে, এই জাল নোট কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির জন্য নয়, বরং নাশকতামূলক কার্যক্রমে অর্থায়নের জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে। এ দিকটি সবচেয়ে ভয়াবহ। কারণ, সন্ত্রাসী সংগঠন বা অরাজনৈতিক সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারীরা যদি খুব সহজে বিপুল পরিমাণ নোট হাতে পায়, তবে তারা তা অস্ত্র, বিস্ফোরক বা ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে শুধু অর্থনীতি নয়, রাষ্ট্রের সামগ্রিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ বিষয়ে অবগত রয়েছে এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে এই অপতৎপরতা প্রতিহত করার জন্য। তবে সীমান্ত দীর্ঘ হওয়ায় এবং নানা চোরাচালান রুট থাকায় পুরোপুরি প্রতিরোধ করা অত্যন্ত কঠিন। সীমান্তে নিয়মিত নজরদারি ও জাল নোট ধরার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকা সত্ত্বেও, যেহেতু এই নোটগুলো এতটাই নিখুঁতভাবে তৈরি, তাই সহজে সেগুলো শনাক্ত করা যায় না। ফলে বাংলাদেশি নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। নগদ অর্থ লেনদেনের সময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখা, ব্যাংকের নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নোট যাচাই করা এবং কোনো সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো জরুরি।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারকে বহুমুখী উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমত, কূটনৈতিক পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে কঠোর আলোচনা জরুরি, যাতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের এই ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নোট শনাক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়ত, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে তারা বুঝতে পারেন কিভাবে আসল ও নকল নোট আলাদা করা যায়। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ ধরনের ষড়যন্ত্র যদি অব্যাহত থাকে তবে তা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই ক্ষতি করবে না, বরং বাংলাদেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক পরিবেশ ও জাতীয় নিরাপত্তা সবকিছুকেই নড়বড়ে করে তুলতে পারে। ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, জাল নোটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে একটি দেশকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেওয়া সম্ভব। পাকিস্তানও একসময় এ ধরনের অভিযোগের মুখে পড়েছিল, আর এখন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একই কৌশল প্রয়োগের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
অর্থনীতি হলো একটি দেশের মেরুদণ্ড। যদি সেই মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে জাল নোট ঢোকানো হয়, তবে তা সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য। তবে এই যুদ্ধ দৃশ্যমান নয়, বন্দুক বা গোলার শব্দ নেই, বরং আছে কাগজের টুকরো, যা দেখতে আসল মনে হলেও ভেতরে ভেতরে দেশকে শোষণ করছে। বাংলাদেশের সামনে তাই এখন দ্বৈত চ্যালেঞ্জ—একদিকে সীমান্ত ও গোয়েন্দা পর্যায়ে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা, অন্যদিকে দেশের ভেতরে নাগরিক সচেতনতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জোরদার করা।
জুলকারনাইনের এই তথ্য যদি পুরোপুরি সত্য প্রমাণিত হয়, তবে এটি শুধু সাংবাদিকতার একটি খবর নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার একটি সতর্ক সংকেত। প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব হবে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা এবং সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করা। কারণ জাল নোটের এই অদৃশ্য যুদ্ধ কেবল রাষ্ট্রযন্ত্রের একার পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। জনগণকেও সজাগ থেকে অংশ নিতে হবে এই প্রতিরোধ যুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য সমন্বিত উদ্যোগই হতে পারে একমাত্র কার্যকর সমাধান।
আপনার মতামত জানানঃ