বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বের উত্থান নতুন দিগন্ত খুলেছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তী বছরগুলোতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনগুলো দেশে রাজনৈতিক চিত্রে সরসার্ধ পরিবর্তন এনেছে। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরা পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতির ময়দানে নিজেদের পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এ প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, তরুণদের নিয়ে গঠিত দুটি দল—গণঅধিকার পরিষদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—একত্রিত হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই একীভূতকরণ শুধুমাত্র দুই দলের মধ্যে বন্ধুত্ব বা সমন্বয়ের বিষয় নয়, বরং এটি জাতীয় রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বকে শক্তিশালী করার প্রয়াস।
গণঅধিকার পরিষদ ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তিতে তৈরি হয়। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা পরে ২০২১ সালে দলীয় কাঠামো গড়ে তোলেন। নুরুল হক নূর, রাশেদ খান, নাহিদ ইসলাম ও আখতার হোসেনের মতো নেতারা এই আন্দোলনের মূল স্তম্ভ ছিলেন। ডাকসু নির্বাচনে তারা একই প্যানেল থেকে অংশগ্রহণ করে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে। একদিকে তরুণদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সুসংহত করার প্রয়াস ছিল, অন্যদিকে তাদের লক্ষ্য ছিল শিক্ষাগত এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি গড়ে ওঠে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে। এই দলটি জন্ম নেয় তরুণদের সক্রিয় রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে এবং দ্রুতই জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করে।
দুই দলের নেতাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের ইতিহাস পরস্পরের সঙ্গে সুসংগত। এনসিপির অনেক নেতা নূরের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপি উভয়ই তরুণ নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল এবং তাদের কার্যক্রমে ভিন্নমতের চিহ্ন সীমিত। এই ঐক্যবদ্ধ চিন্তা দুই দলের একত্রিকরণের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর, যখন তরুণরা দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে, তখন এ ধরনের জোট তৈরির প্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
একীভূতকরণের বিষয়টি শুধু রাজনৈতিক সমন্বয় নয়, এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। ২০২৫ সালের নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর দুই দলের নেতারা বুঝতে পেরেছেন, নির্বাচনের আগে শক্তিশালী একটি তরুণ জোট গড়ে তোলার প্রয়োজন। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে দুটি দলের সমর্থিত প্যানেল ব্যর্থ হওয়ায় এই সিদ্ধান্তকে আরও যৌক্তিক মনে করা হচ্ছে। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান জানাচ্ছেন, তরুণদের বিভাজনের কারণে নির্বাচনে ফলাফল খারাপ হয়েছে, তাই একটি সংহত কাঠামো তৈরি করাই সফলতার চাবিকাঠি।
একত্রিতকরণের প্রক্রিয়া নিয়ে এখনও কিছু বিষয় আলোচনার অধীনে রয়েছে। বিশেষত, একটি নিবন্ধিত দল ও একটি অনিবন্ধিত দল কীভাবে এক হবে, নেতৃত্ব কাঠামো কেমন হবে, পদবিন্যাস কী হবে—এই বিষয়গুলো এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে দলীয় নেতারা আশা প্রকাশ করছেন, নাহিদ ইসলাম ও নুরুল হক নূর শীর্ষ নেতৃত্বের জন্য অগ্রণী থাকবেন। এছাড়া আখতার হোসেনসহ গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বকেই নেতৃত্বের অংশ হিসেবে রাখা হবে। দলের নাম নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি; তবে দুই দল আগের নাম ব্যবহার করতে পারে বা নতুন কোনো নামেই আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই একত্রিকরণ দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে এটি জাতীয় নির্বাচনের আগে শক্তিশালী তরুণ ফ্রন্ট গড়ে তুলতে সাহায্য করবে, অন্যদিকে এটি দলীয় বিভাজন কমিয়ে রাজনীতিতে একক পরিচিতি স্থাপন করবে। গণঅধিকার পরিষদ একটি নিবন্ধিত দল, যার অসংখ্য নেতা-কর্মী রয়েছে। অন্যদিকে, এনসিপি সম্প্রতি নিবন্ধন পেয়েছে এবং তারা জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে চাইছে। দুই দলের নেতারা একমত হয়েছেন যে, নেতৃত্ব নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। কালেক্টিভ লিডারশিপের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদ বন্টন করা হবে।
দুই দলের একত্রিকরণের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো নতুন বাংলাদেশের দিকে কাজ করা। তারা সমতার মূলনীতি, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও জাতীয় সনদের বাস্তবায়নের প্রতি নিবদ্ধ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই নতুন রাজনৈতিক গঠন তরুণ ভোটারদের মধ্যে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। এটি শুধু নির্বাচনে জয়লাভের জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং তরুণ নেতৃত্বের ধারাকে সুসংহত করার প্রচেষ্টা।
রাজনীতির মাঠে প্রবেশের আগে দুই দলের নেতারা কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠকের পাশাপাশি দলীয় পর্যায়ে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এনসিপির নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জানাচ্ছেন, গণঅধিকার পরিষদ তাদের দলে যোগ দেবে এবং ব্যানারসহ অন্যান্য সবকিছু ‘ডিজলভ’ করার প্রক্রিয়া চলবে। এই প্রক্রিয়ায় দলীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বজায় রাখা হবে।
গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপি একত্রিত হলে নেতাদের রাজনৈতিক পরিপক্কতা এবং ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতা জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এই দুই দলের নেতারা বিভিন্ন আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানে একসাথে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা নতুন দলকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। বিশেষ করে নুরুল হক নূরের নেতৃত্ব তরুণ ভোটারদের আস্থা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই একত্রিকরণ নির্বাচনের আগে বড় দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা বা জোট গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য আসন লাভের জন্য এটি একটি কৌশলগত উদ্যোগ। ভোটাররা দেখবে, তরুণ নেতৃত্বে বিভাজন নেই, ফলে তাদের ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। দুই দলের নেতারা মনে করছেন, ধর্মীয় রাজনীতি এখানে স্থান পাবে না। রাষ্ট্র সংক্রান্ত প্রশ্নে কোনো ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হবে না; রাষ্ট্র সকল ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করবে।
নতুন দল গড়ে উঠলে রাজনৈতিক কার্যক্রমের ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। ছাত্র অধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার ও তরুণ নেতৃত্বের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশীয় রাজনীতিতে নতুন শক্তি যোগ হবে। নেতা হিসেবে নাহিদ ইসলাম, নুরুল হক নূর ও আখতার হোসেনকে শীর্ষে রাখা হলে দলটি একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। এই দলীয় কাঠামো নতুন রাজনৈতিক প্রজন্মের জন্য উদাহরণ তৈরি করবে।
দুই দলের একত্রিকরণের বিষয়টি স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। দলীয় কর্মসূচি ও নেতাদের একত্রিত হওয়ার উদ্যোগ দেশজুড়ে তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক সক্রিয়তা বৃদ্ধি করবে। বিভিন্ন আন্দোলন ও ভোট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
রাজনীতিতে তরুণদের ভূমিকা ইতোমধ্যেই লক্ষ্যণীয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত, তরুণরা সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার জন্য আন্দোলন করেছেন। এবার এই শক্তি একটি সংগঠিত রাজনৈতিক ফ্রন্টের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তরুণ নেতৃত্বের এই একীকরণের ফলে রাজনৈতিক দিগন্তে একটি নতুন মাত্রা যোগ হবে।
দল দুটি একত্রিত হলে তারা শুধু নির্বাচনে নয়, সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। নতুন দলটি সমতা, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার এবং জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবে। এটি তরুণ ভোটারদের আস্থা বৃদ্ধি করবে এবং রাজনৈতিক বিভাজন কমাবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচনের আগে শক্তিশালী এই তরুণ জোট গড়ে তোলা প্রয়োজন।
এই একীকরণের প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব, পদবিন্যাস, দলীয় নাম এবং কর্মসূচি সংক্রান্ত বিষয়গুলো আলোচনার অধীনে রয়েছে। তবে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। দুই দলের নেতারা আশা প্রকাশ করছেন, এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং তরুণ নেতৃত্বের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করবে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দলটি জাতীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।
সার্বিকভাবে দেখা যায়, গণঅধিকার পরিষদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টির একীকরণ কেবল দুই দলের রাজনৈতিক সংমিশ্রণ নয়, এটি তরুণ নেতৃত্বের শক্তি, দলীয় সংস্কৃতি ও জাতীয় রাজনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা। এটি নির্বাচনের আগে শক্তিশালী রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি করবে এবং দেশজুড়ে তরুণ ভোটারদের আস্থা ও অংশগ্রহণ বাড়াবে। নতুন দলটি সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের মূল্যবোধ বজায় রেখে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
আপনার মতামত জানানঃ