২০২৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা ও পশ্চিম তীরে যখন প্রতিদিন মানুষের প্রাণহানি ঘটছে, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দুই রাষ্ট্র সমাধানকে প্রায় অকার্যকর দেখতে পাচ্ছে, তখন তিনটি পশ্চিমা শক্তিধর রাষ্ট্রের এই ঘোষণা কেবল কূটনৈতিক তাৎপর্যই বহন করে না—বরং এটি ইসরায়েলের জন্য এক গভীর নৈতিক পরাজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এ সিদ্ধান্তের তাৎক্ষণিক পটভূমি হলো গাজায় চলমান ভয়াবহ মানবিক সংকট। লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু, হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র ধ্বংস, পানীয় জল ও খাদ্যের তীব্র সংকট, ওষুধের অভাব—এসব দৃশ্য এখন পুরো বিশ্বের চোখে অঙ্কিত। এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান কেবল নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার গল্প নয়, বরং মানবাধিকারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার সরকারগুলো স্পষ্ট করে জানিয়েছে, তারা এই স্বীকৃতির মাধ্যমে দুই রাষ্ট্র সমাধানকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, কারণ ইসরায়েলি নীতি প্রতিদিনই সেই সমাধানের ভিত্তি ধ্বংস করছে।
ইসরায়েল এই পদক্ষেপকে স্বাভাবিকভাবেই শত্রুতামূলক বলেছে। তাদের মতে, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে “সন্ত্রাসীদের পুরস্কৃত করা।” কিন্তু এ বক্তব্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গন খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। কারণ বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের দাবিকে উপেক্ষা করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু আন্তর্জাতিক নৈতিকতার আদালতে সেটা টিকে না।
পশ্চিমা বিশ্বে ফিলিস্তিন স্বীকৃতির প্রশ্নটি দীর্ঘদিন বিভক্ত ছিল। ইউরোপের কিছু দেশ আগেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেও যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা দীর্ঘদিন মার্কিন নীতির ছায়াতলে থেকে বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে। এবার তারা অবস্থান বদলেছে, আর এই পরিবর্তন ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা। কারণ পশ্চিমা মিত্রশক্তির নীরব সমর্থন ছিল ইসরায়েলের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। যখন সেই সমর্থনে ফাটল দেখা দেয়, তখন সামরিক শক্তি বা অর্থনৈতিক ক্ষমতা দিয়েও সেই ক্ষতিপূরণ করা যায় না।
এই স্বীকৃতি ইসরায়েলের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করেছে কয়েকটি কারণে। প্রথমত, এটা প্রমাণ করেছে যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আর শুধু প্রান্তিক বা মুসলিম বিশ্বের কণ্ঠে সীমাবদ্ধ নেই; বরং পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোও এখন প্রকাশ্যে বলছে, ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করা যায় না। দ্বিতীয়ত, এটি জনমতের বিজয়। পশ্চিমা দেশগুলোর ভেতরে দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়, মানবাধিকার সংস্থা, এবং সাধারণ নাগরিকরা ফিলিস্তিনের মুক্তির পক্ষে আওয়াজ তুলছিল। সরকারগুলো অবশেষে সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে। তৃতীয়ত, ইসরায়েল নিজেকে যে মানবিকতা ও গণতন্ত্রের মডেল বলে দাবি করত, সেই দাবিই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ তিনটি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্পষ্টভাবে বলেছে—মানবিকতার খাতিরে, ন্যায়বিচারের খাতিরে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।
এই স্বীকৃতির কূটনৈতিক তাৎপর্যও গভীর। ফিলিস্তিন এখন আন্তর্জাতিকভাবে আরও বেশি বৈধতা পাবে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সংস্থায় অংশ নেওয়ার সুযোগ বাড়বে। তাদের রাষ্ট্রীয় সত্তাকে আর কেবল প্রতীকী বা কল্পিত দাবি বলা যাবে না। এর মানে হলো, ভবিষ্যতের শান্তি আলোচনায় ফিলিস্তিনিরা আর “অবৈধ গোষ্ঠী” হিসেবে নয়, বরং আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্র হিসেবে বসবে। এতে ইসরায়েলের একতরফা নীতি—যেমন পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ বা গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ—আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
ইসরায়েলের নৈতিক পরাজয়ের আরেকটি দিক হলো ঐতিহাসিক দায়। যুক্তরাজ্য যে দেশ একসময় বিফোর ঘোষণা ও ম্যান্ডেট যুগের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ভূমির ভাগ্য নির্ধারণে সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল, সেই দেশ আজ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এটি যেন অতীতের ভুলের সংশোধন। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার ক্ষেত্রেও উপনিবেশ-উত্তর মানবাধিকার চেতনা এই স্বীকৃতির পেছনে কাজ করেছে। ফলে ইসরায়েলের জন্য এটি কেবল বর্তমানের নীতি নয়, বরং ইতিহাসেরও নৈতিক বিচারের মতো প্রতীয়মান।
অবশ্য, এই স্বীকৃতি মানেই যে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা রাতারাতি প্রতিষ্ঠিত হবে, তা নয়। বাস্তব পরিস্থিতি এখনও কঠিন। ইসরায়েলের সামরিক শক্তি অটুট, যুক্তরাষ্ট্র তাদের দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছে। ফিলিস্তিনি রাজনীতির ভেতরেও বিভক্তি রয়েছে। তবে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির এই ঢেউ স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে ইসরায়েল চাইলেও বিশ্বকে দীর্ঘদিন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি থেকে বিরত রাখতে পারবে না।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বোঝা গেল, কেবল সামরিক বিজয় যথেষ্ট নয়। যুদ্ধ জেতা যায়, কিন্তু নৈতিকতার আদালতে হারা যায়। ইসরায়েলের জন্য সেটাই হচ্ছে এখন। তারা হয়তো ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে, সীমান্তের গতি নিয়ন্ত্রণ করছে, কিন্তু মানুষের হৃদয়, বিশ্বমানবতার সহানুভূতি আর আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে তারা পিছিয়ে পড়ছে। ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি তাই এক প্রতীক—অত্যাচার ও দমননীতি যতই দীর্ঘায়িত হোক, ন্যায়বিচার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি শেষ পর্যন্ত জায়গা করে নেয়।
এই স্বীকৃতি পশ্চিমা রাজনীতির জন্যও নতুন মোড়। এটি প্রমাণ করেছে, মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি আর কেবল ইসরায়েলের একক স্বার্থে নির্ধারিত হবে না। বরং ফিলিস্তিনকেও এখন এক আনুষ্ঠানিক সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ইসরায়েলকে যদি আন্তর্জাতিক সমাজে টিকে থাকতে হয়, তবে তাদের নীতি ও অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
সব মিলিয়ে, ফিলিস্তিনকে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক বড় মোড়। এটি শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য আশার আলো নয়, বরং ইসরায়েলের জন্য স্পষ্ট বার্তা—শক্তি দিয়ে সবকিছু দমন করা যায় না, মানবিকতা ও নৈতিকতার পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে শেষ পর্যন্ত একদিন সমর্থনও হারাতে হয়। ইসরায়েলের নৈতিক পরাজয়ের এটাই প্রমাণ।
আপনার মতামত জানানঃ