মানুষের ইতিহাস আসলে বেঁচে থাকার এক অনন্ত সংগ্রামের কাহিনি। হাজার বছরের অভিযাত্রায় মানুষ ধীরে ধীরে শিকারি-সংগ্রাহক সমাজ থেকে কৃষিনির্ভর সভ্যতায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু এর বহু আগেই মানুষ প্রকৃতির ভয়ংকর শক্তির সঙ্গে লড়াই করে তার বেঁচে থাকার কৌশল গড়ে তোলে। সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা যাচ্ছে, আজ থেকে প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে মানুষ শুধু স্থলভাগে পশুপাখি শিকারেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তারা গভীর সমুদ্রে নেমে হাঙরের মতো ভয়ঙ্কর প্রাণীকেও শিকার করত। এ আবিষ্কার মানব ইতিহাসের অজানা অধ্যায় উন্মোচন করেছে, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রা, সাহসিকতা এবং বুদ্ধিমত্তার এক বিস্ময়কর চিত্র তুলে ধরে।
হাঙর সবসময়ই মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর প্রতীক। আধুনিক যুগেও সমুদ্রসৈকতের কাছে হাঙরের হামলার খবর মানুষকে আতঙ্কিত করে। অথচ কল্পনা করা কঠিন—যখন কোনো ধাতব অস্ত্র ছিল না, যখন নৌকাও ছিল প্রাথমিক কাঠামোর, তখন মানুষ কীভাবে সমুদ্রের গভীরে গিয়ে এমন প্রাণী শিকার করত। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, পাপুয়া নিউ গিনি ও ফিলিপাইন অঞ্চলে পাওয়া প্রমাণগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, প্রাচীন মানুষ শুধু উপকূলবর্তী মাছ বা ঝিনুক আহরণ করত না, বরং হাঙরের দাঁত সংগ্রহ করত শিকার হিসেবে। সেই দাঁতগুলোকে তারা অলঙ্কার, অস্ত্র বা প্রতীকী বস্তু হিসেবে ব্যবহার করত।
এ ধরনের প্রমাণ প্রথম নজরে আসে সমুদ্র উপকূলবর্তী প্রত্নস্থানে খননের সময়। গবেষকরা দেখতে পান, বহু পুরনো কবর বা বসতিস্থলে হাঙরের দাঁতের তৈরি অলঙ্কার পাওয়া যাচ্ছে। এর অনেকগুলিই সঠিক আকারে ঘষে-মেজে গহনার মতো বানানো। দাঁতের ধারালো প্রান্ত আবার অনেকসময় বর্শা বা কাঁটায় লাগানো হয়েছে। এগুলো কেবল সংগ্রহশৌখিন বস্তু নয়, বরং যুদ্ধ বা আত্মরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হতো। এতে বোঝা যায়, হাঙর শিকার শুধু খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ছিল না; বরং সামাজিক মর্যাদা ও সাংস্কৃতিক প্রতীকের সঙ্গেও এর সম্পর্ক ছিল।
প্রাচীন মানুষরা কীভাবে হাঙর শিকার করত, তা নিয়ে এখনও গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। একটি মত হলো, তারা অগভীর সমুদ্রেই অপেক্ষা করত এবং আটকা পড়া বা ধীরগতির হাঙরকে আক্রমণ করত। আবার অনেকে মনে করেন, তারা প্রাথমিক ভেলা বা নৌকায় চড়ে গভীর জলে যেত। সেক্ষেত্রে হাতে বানানো পাথরের বর্শা, হাড়ের কাঁটা বা ধারালো দাঁত লাগানো লাঠি ব্যবহার করা হতো। প্রমাণ মিলেছে যে, প্রাচীন নৌকার কাঠামো ৪০ হাজার বছর আগেও বিদ্যমান ছিল, যা দ্বীপাঞ্চলে মানুষের অভিবাসনকে সম্ভব করেছিল। তাই হাঙর শিকারের ক্ষেত্রেও নৌকা ব্যবহারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
হাঙর শিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিষয় হলো খাদ্যাভ্যাস। হাঙরের মাংস প্রোটিনে ভরপুর। উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা দীর্ঘসময় ধরে সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর নির্ভর করে এসেছে। তবে হাঙরের মাংস সংরক্ষণ করা কঠিন ছিল। তাই ধারণা করা হয়, তারা দ্রুত রান্না করে খেত বা শুকিয়ে রাখত। হাঙরের চর্বি বা তেল আগুন জ্বালাতে কিংবা প্রলেপ হিসেবে ব্যবহার করা হতো বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
প্রাচীন মানুষের সাহসিকতার দিকটিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। হাঙর শুধু বিশাল আকারেরই নয়, অতি দ্রুতগামী ও আক্রমণাত্মক প্রাণী। এ প্রাণীর বিরুদ্ধে নামা মানে ছিল প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করা। তাই হাঙর শিকারিদের সমাজে বিশেষ সম্মান দেওয়া হতো। যোদ্ধা বা শিকারির মর্যাদা অনেকটা উপজাতীয় নেতার মতো ছিল। অনেক গবেষক বলেন, যেসব কবর থেকে হাঙরের দাঁতের অলঙ্কার পাওয়া গেছে, সেগুলো সম্ভবত ওই সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমাধি। এতে বোঝা যায়, হাঙর শিকার শুধু খাদ্য সংগ্রহ নয়, বরং সামাজিক প্রতীকও হয়ে উঠেছিল।
বর্তমান সময়ের প্রত্নতত্ত্ববিদরা যখন এ আবিষ্কারগুলো বিশ্লেষণ করেন, তখন তারা মানবজাতির অভিযাত্রার এক নতুন দিক দেখতে পান। এতদিন ধারণা ছিল, প্রাচীন মানুষ মূলত স্থলভাগকেন্দ্রিক শিকারি ছিল। কিন্তু হাঙর শিকার প্রমাণ করে, তারা সমুদ্রকেন্দ্রিক অভিযাত্রায়ও সমান পারদর্শী ছিল। এ দক্ষতা ছাড়া তারা কখনো দ্বীপ থেকে দ্বীপে অভিবাসন করতে পারত না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত মানব বসতির বিস্তার আসলে এই নৌকাচালনা ও সমুদ্রশিকারের ওপর নির্ভর করেছিল।
মানব ইতিহাসের এ নতুন তথ্য আধুনিক বিজ্ঞানকেও ভাবাচ্ছে। কারণ, এত আগে থেকেই যদি মানুষ সমুদ্রশিকার করতে সক্ষম হয়ে থাকে, তবে তাদের জ্ঞান, কৌশল এবং সংগঠনের স্তর আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। শিকার অভিযানে একাধিক মানুষের সমন্বয় প্রয়োজন হতো—কেউ নৌকা চালাত, কেউ ফাঁদ পাতত, কেউ অস্ত্র নিক্ষেপ করত। অর্থাৎ, হাঙর শিকার দলগত বুদ্ধি ও সহযোগিতার নিদর্শনও বটে।
হাঙরের দাঁতের প্রতীকী ব্যবহারও মনোবিজ্ঞানীদের আকর্ষণ করছে। প্রাচীন মানুষের কাছে হাঙরের দাঁত ছিল ভয় জয় করার প্রতীক। হয়তো এটি যুদ্ধজয়ের প্রতীকী নিদর্শন হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। আধুনিক যুগেও আমরা দেখি, অনেক দ্বীপাঞ্চলের উপজাতি সমাজে হাঙরের দাঁতকে সাহস ও শক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে, হাজার বছরের ব্যবধানেও কিছু প্রতীকী চর্চা টিকে থাকে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কেন প্রাচীন মানুষ এত ঝুঁকি নিয়ে হাঙর শিকার করত? খাদ্যের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ মাছ, কচ্ছপ কিংবা ঝিনুকও তো ছিল। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এখানে সাংস্কৃতিক মর্যাদা সবচেয়ে বড় কারণ। যে সমাজে সাহসিকতা টিকে থাকার অন্যতম শর্ত, সেখানে হাঙর শিকারিদের আলাদা স্থান ছিল। অনেকটা আজকের যুগে সেনা বা যোদ্ধার মর্যাদার মতো। এ কারণেই হয়তো শিকার শেষে দাঁত সংগ্রহ করে অলঙ্কারে রূপান্তরিত করা হতো।
বর্তমান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার আমাদের বোঝায়, মানুষ কেবল জীবিকা নির্বাহের জন্যই অভিযাত্রী ছিল না, বরং তার ভেতরে ছিল অজানাকে জয়ের অদম্য স্পৃহা। ভয়ঙ্কর সমুদ্র আর হাঙরের মতো শিকার সেই স্পৃহাকেই প্রতিফলিত করে। তাই বলা যায়, হাঙর শিকারের ইতিহাস আসলে মানুষের বেঁচে থাকার ইতিহাসের পাশাপাশি তার সাহসিকতা ও উদ্ভাবনশীলতার এক অনন্য সাক্ষ্য।
আজকের আধুনিক সভ্যতায় আমরা সমুদ্রের গভীরে পারমাণবিক সাবমেরিন নামাই, অতি আধুনিক জাহাজে চড়ে সাগরপাড়ি দিই। অথচ ৪০ হাজার বছর আগে কোনো আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই আমাদের পূর্বপুরুষরা একই সাগরে নেমেছিল। তারা শুধু বেঁচে থাকার জন্য শিকার করেনি, বরং সেই শিকারকে প্রতীকে রূপান্তর করেছে। আর এভাবেই মানবসভ্যতার প্রাচীন কাহিনি আমাদের জানায়—মানুষ সবসময় অজানাকে জয় করতে চেয়েছে, ভয়কে প্রতীকে রূপান্তর করেছে, আর সেই স্পৃহাই তাকে আজকের অবস্থানে এনেছে।
আপনার মতামত জানানঃ