
জাগ্রোস পর্বতমালার পাদদেশে নরম মাটি সরাতে সরাতে যখন আচমকা উদ্ভাসিত হলো বিশাল একটি দেয়ালের রেখা, খননকারীরা প্রথমে ভাবতেই পারেননি—তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ হাজার বছর আগের এক স্মৃতিস্তম্ভের অবশিষ্ট অংশ। উত্তর ইরাকের কানি শাই নামের এই প্রত্নস্থানে তুলে আনা প্রতিটি ইট, প্রতিটি ভাঙা শিলামূর্তি যেন বলতে শুরু করেছে সেকালের এক অজানা গল্প। যে যুগে পৃথিবীতে শহর মানে ছিল নতুন এক ধারণা, সে সময়েই এখানে দাঁড়িয়ে ছিল এক বিরাট সরকারি বা ধর্মীয় ভবন—যার কক্ষগুলোতে আলো জ্বলে উঠত প্রদীপে, যেখান দিয়ে হাঁটা দিত প্রাচীন নগরজীবনের কর্মকর্তা, পুরোহিত আর ব্যবসায়ীরা।
গত সেপ্টেম্বরের এই আবিষ্কারকে কেন্দ্র করে এখন নতুন করে আলোচনায় এসেছে উরুক যুগ, আনুমানিক ৩৩০০ থেকে ৩১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সেই সময়কে ঘিরে, যখন মানবসভ্যতা প্রথমবারের মতো পরিকল্পিত শহর গড়তে শুরু করে। কানি শাইয়ের ভবনটি যে এই উরুক যুগের, তা স্থাপত্যশৈলী ও পাওয়া নিদর্শন থেকে বেশ দৃঢ়ভাবেই অনুমান করছেন গবেষকেরা। এই যুগের নামই এসেছে দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার বিখ্যাত উরুক শহর থেকে—যে শহরটিকে অনেকে পৃথিবীর প্রথম প্রকৃত শহর বলে মনে করেন। প্রায় ৮০ হাজার মানুষের বসতির সেই উরুকে ছিল আলাদা আলাদা আবাসিক এলাকা, প্রশাসনিক অঞ্চল, পরিকল্পিত সড়ক, এমনকি পূজা ও শাসনের জন্য আলাদা কমপ্লেক্স। কিউনিফর্ম লিপি, সংখ্যার ব্যবহার, কৃষিপণ্যের হিসাব—সবকিছুরই সূচনা এই পৃথিবীর ওই প্রাচীন শহরেই।
এই প্রেক্ষাপটে কানি শাইয়ের অবস্থানকে আরও রহস্যময় করে তোলে তার ভৌগোলিক দূরত্ব। উরুক শহর যেখানে দক্ষিণে, সেখানে কানি শাই অবস্থিত উত্তরে, প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার দূরে। আজকের মানদণ্ডে হয়তো এই দূরত্ব খুব বড় কিছু মনে নাও হতে পারে। কিন্তু পাঁচ হাজার বছর আগে, যখন গাড়ি, ট্রেন, বিমান কিছুই ছিল না—তখন এই পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে সময় লাগত প্রায় পনের দিন। এতদিন পর্যন্ত তাই অনেক গবেষকই ভাবতেন, উরুক সভ্যতার মূল কেন্দ্র থেকে এতটা দূরে হওয়ায় কানি শাই হয়তো এক প্রত্যন্ত, গৌণ বসতি; একধরনের ‘প্রান্তিক গ্রাম’, যার বড় কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক খননকার্য যেন এই ধারণাকে পুরোটাই ওলটপালট করে দিচ্ছে।
কারণ, কানি শাইয়ে যে ভবনের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে, তার আকার, বিন্যাস আর নির্মাণশৈলী একেবারেই কোনো সাধারণ বাড়ির মতো নয়। দেয়ালের পুরুত্ব, ঘরের বিন্যাস, প্রবেশপথের পরিকল্পনা—সব মিলিয়ে স্পষ্ট, এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভবন। গবেষকেরা ধারণা করছেন, এটি হয়তো একটি মন্দির বা কাল্টিক স্পেস, যেখানে ধর্মীয় আচার পালনের পাশাপাশি প্রশাসনিক কার্যক্রমও পরিচালিত হতো। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় মন্দির মানেই ছিল শুধু প্রার্থনার জায়গা নয়; সেগুলো ছিল কর আদায়, খাদ্য–সংরক্ষণ, হিসাবরক্ষণ আর রাজনীতিরও কেন্দ্র। অর্থাৎ, ধর্ম আর ক্ষমতা সেখানে একই ভবনের ভেতরে পাশাপাশি বসবাস করত।
এই ধারণাকে শক্তিশালী করেছে ভবনটির ভেতর থেকে পাওয়া একাধিক বিস্ময়কর নিদর্শন। এর মধ্যে প্রথমেই আসে সিলিন্ডার সিলের কথা। এগুলো আসলে একধরনের নকশা–খোদাই করা শিলমোহর, যা ভেজা মাটির ওপর গড়িয়ে নিলে লম্বা নকশা বা লেখা উঠে আসে। উরুক যুগে এগুলো ব্যবহার করা হতো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, পণ্য–বিনিময়, মালিকানা কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে। কানি শাইয়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে এমন সিলিন্ডার সিলের উপস্থিতি প্রমাণ করছে, এখানে নিশ্চয়ই এক ধরনের সংগঠিত প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা চালু ছিল, যেখানে হিসাব রাখা হতো, সীলমোহর দেওয়া হতো, আর নথিপত্র তৈরি করা হতো উরুকের একই ধাঁচের পদ্ধতি অনুসরণ করে।
তার সঙ্গে পাওয়া গেছে একটি সোনার লকেটের ভাঙা অংশ। এই ছোট্ট বস্তুটি অনেক বড় কয়েকটি গল্প বলে। প্রথমত, এত পুরোনো সময়ে সোনার অলংকারের ব্যবহারের মাধ্যমে বোঝা যায়—এখানকার মানুষ শুধু বেঁচে থাকাই শিখে নেয়নি, শিখেছে সৌন্দর্য ও প্রতPrestige প্রদর্শনের কৌশলও। দ্বিতীয়ত, এতে ইঙ্গিত মেলে এক শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজব্যবস্থার, যেখানে কারও কাছে সোনার লকেট কেনার সামর্থ্য ছিল, আবার কেউ হয়তো তার মালিকানার অধীনেই কাজ করত। অর্থাৎ, কানি শাই কেবল কোনো দরিদ্র সীমান্ত–গ্রাম ছিল না; বরং শাসক বা উচ্চবিত্ত গোষ্ঠীর উপস্থিতি এখানেও ছিল দৃশ্যমান।
সবচেয়ে অবাক করা আবিষ্কারগুলোর একটি হলো ‘ওয়াল কোন’ বা দেয়ালে ব্যবহৃত শঙ্কু আকৃতির সাজসজ্জা। পোড়ামাটি বা পাথরের তৈরি এই শঙ্কুগুলোর সূচালো অংশ ভেজা প্লাস্টারের দেয়ালে গেঁথে দেওয়া হতো, আর চ্যাপ্টা মাথাটা রঙ দিয়ে সাজানো হতো নানা জ্যামিতিক নকশায়। ফলে পুরো দেয়াল জুড়ে তৈরি হতো এক চমৎকার মোজাইক প্যাটার্ন—যা একদিকে সৌন্দর্য বাড়াত, অন্যদিকে ভবনের স্বাস্থ্যকরতা ও স্থায়িত্বেও ভূমিকা রাখত। এমন ওয়াল কোন সাধারণ বসতি–বাড়িতে খুব কমই দেখা যায়; সাধারণত মন্দির বা প্রাসাদঘেঁষা গুরুত্বপূর্ণ ভবনেই এ ধরনের কারুকাজ করা হত। তাই গবেষকেরা যখন কানি শাইয়ের দেয়ালে এমন ওয়াল কোন খুঁজে পেয়েছেন, তখন তাঁরা একরকম নিশ্চিতই হয়েছেন—এটি নিশ্চয়ই কোনো ‘গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বা আনুষ্ঠানিক ভবন’ ছিল।
সব মিলিয়ে চিত্রটা দাঁড়াচ্ছে এমন: পাঁচ হাজার বছর আগে, যখন দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার উরুকে শহুরে সভ্যতা তার পূর্ণ বিকাশে পৌঁছাচ্ছে, ঠিক তখনই উত্তর দিকেও গড়ে উঠেছে এক জটিল নেটওয়ার্ক—যেখানে কানি শাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র। হয়তো এই ভবনের ভেতরে কৃষিপণ্যের হিসাব রাখা হতো, ব্যবসায়ীদের লেনদেন নথিভুক্ত করা হতো, দেব–দেবীর উদ্দেশে উৎসর্গ করা হতো নানা সামগ্রী, আর উচ্চপদস্থ পুরোহিত ও কর্মকর্তারা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন আশপাশের এলাকা কীভাবে পরিচালিত হবে। একেকটি সিলিন্ডার সিল, এক টুকরো সোনার লকেট, এক সারি ওয়াল কোন—সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে সেই অদৃশ্য অতীতের এক টুকরো দৈনন্দিন জীবন।
এই আবিষ্কার সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে এনেছে, তা হলো—উরুক সভ্যতা আসলে কতটা বিস্তৃত ছিল? এতদিন ধারণা ছিল, উরুকের প্রভাব মূলত দক্ষিণ মেসোপটেমিয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল, আর উত্তর দিকের অনেক অঞ্চল ছিল তুলনামূলকভাবে প্রান্তিক। কিন্তু কানি শাইয়ের মতো প্রত্নস্থানে যখন উরুক–ধারার স্থাপত্যশৈলী, প্রশাসনিক সিল, ধর্মীয় কাঠামো—সব মিলিয়ে এক বিস্তৃত ও সংগঠিত ব্যবস্থার ছবি দেখা যায়, তখন বোঝা যায়—এই সভ্যতা শুধু একটি শহর–কেন্দ্রিক বিন্যাস ছিল না; বরং দূর–উত্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা এক বৃহৎ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেটওয়ার্কের নাম ছিল উরুক। কানি শাই সেই নেটওয়ার্কেরই এক উত্তরাঞ্চলীয় কেন্দ্র, যেখানে স্থানীয় সংস্কৃতি আর দক্ষিণের প্রভাব মিলেমিশে তৈরি করেছে এক নতুন পরিচয়।
বিজ্ঞানীরা তাই বলছেন, টাইগ্রিস নদীর পূর্ব দিকে মানুষের বসতির ইতিহাস বোঝার জন্য কানি শাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর একটি। কারণ, এখানে আমরা শুধু একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ দেখছি না; দেখছি কিভাবে এক প্রাচীন রাষ্ট্র তার প্রান্তিক এলাকাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, কিভাবে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তার করেছিল, আর কিভাবে প্রশাসনিক নেটওয়ার্ক দিয়ে সেই প্রভাবকে দীর্ঘস্থায়ী করেছিল। এ যেন কোনো পুরোনো মানচিত্রে নতুন করে দাগ টেনে দেওয়া—যেখানে আগে লেখা ছিল ‘ফাঁকা’ বা ‘অজানা’, সেখানে এখন পাওয়া যাচ্ছে এক পুরো নগরসভ্যতার বিস্তারের প্রমাণ।
আমাদের জন্য এই আবিষ্কারের তাৎপর্য আরও গভীর। আজকের দিনেও আমরা যখন শহর–গ্রাম, কেন্দ্র–প্রান্ত, উন্নত–অনুন্নত ইত্যাদি ভাগে মানুষ আর ভূগোলকে ভাগ করি, তখন কানি শাইয়ের মতো প্রত্নস্থানে এসে যেন ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়—প্রান্তিক মনে করা জায়গাগুলিও অনেক সময় ছিল বড় কোনো গল্পের ভেতরে থাকা প্রধান চরিত্র। উরুকের আলো থেকে অনেক দূরে, পনের দিনের পথ হেঁটে যে মন্দির বা প্রশাসনিক ভবনে মানুষ উপাসনা করত, সিদ্ধান্ত নিত, হিসাব রাখত—তার ধ্বংসস্তূপ আজ আবার কথা বলতে শিখছে মাটির ভেতর থেকে উঠে এসে। আর আমরা, আধুনিক মানুষ, সেই কথাগুলো জোড়া লাগিয়ে নতুন করে লিখতে বসেছি মানবসভ্যতার প্রথম দিকের অধ্যায়গুলো।
আপনার মতামত জানানঃ