
ভারত উপমহাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। অর্থনীতি, কূটনীতি কিংবা সামরিক দিক থেকে দেশটি একটি প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কারণ, বহুমুখী নিরাপত্তা হুমকি একইসাথে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এমন এক সময়ে, যখন প্রতিরক্ষা খাত নানা সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিরক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের ক্রমাগত প্রক্সি যুদ্ধ, চীনের সীমান্ত উত্তেজনা এবং সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতের সামরিক কৌশলের জন্য নতুন মাত্রার চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এ অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভেতরের ঘাটতিগুলো আরও প্রকট হয়ে উঠছে।
ভারতের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ও স্থায়ী হলো পাকিস্তান। কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের বৈরিতা শুরু হয় সাত দশকেরও আগে, আর তা আজও অব্যাহত রয়েছে। পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে সন্ত্রাসবাদ ও প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। একইসাথে ইসলামাবাদের সামরিক পরিকল্পনা ভারতের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ওপর কেন্দ্রীভূত। এই প্রবণতা ভারতকে সীমান্তে ব্যাপক জনবল ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করতে বাধ্য করছে। অন্যদিকে, চীন বরাবরের মতোই লাদাখসহ সীমান্ত এলাকায় চাপ সৃষ্টি করছে। গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে শীতলতা আরও বেড়েছে। চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ভারতের জন্য উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর বাইরে নতুন করে বাংলাদেশের দিকে নজর পড়ছে। ঢাকার রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ভারতবিরোধী মনোভাব বেড়ে চলেছে বলে দাবি করছে দিল্লিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলো। পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলে ভারতের পূর্ব সীমান্তে নতুন ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ফলে একসাথে তিনটি ফ্রন্টে নিরাপত্তা হুমকি দেখা দিচ্ছে, যা ভারতের জন্য অভূতপূর্ব পরিস্থিতি।
তবে ভারতের সবচেয়ে বড় সংকট বাহ্যিক হুমকির চেয়ে অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতায়। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম সংগ্রহে দীর্ঘসূত্রিতা, বিদেশি আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং জনবলের ঘাটতি সেনাবাহিনীর দক্ষতাকে ব্যাহত করছে। মোদি সরকারের অধীনে আত্মনির্ভর প্রতিরক্ষা প্রকল্প শুরু হলেও তা এখনও প্রত্যাশিত মাত্রায় সফল হয়নি। বিদেশি সরঞ্জামের ওপর নির্ভরতা কমেনি। রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত যুদ্ধবিমানগুলোর বড় অংশ জরুরি আপগ্রেডের প্রয়োজন অথবা অবসরের পথে। ফলে ভারতীয় বিমানবাহিনী ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। অনুমোদিত ৪২ স্কোয়াড্রনের বিপরীতে এখন সক্রিয় স্কোয়াড্রন মাত্র ৩১টি। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই রাশিয়ান তৈরি। যন্ত্রাংশের জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীলতা যেকোনো সংঘাত পরিস্থিতিতে মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
নৌবাহিনীর অবস্থাও তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। বিমানবাহী রণতরীগুলো পর্যাপ্ত যুদ্ধবিমান ছাড়াই চলছে। দেশীয় উৎপাদন চাহিদা মেটাতে পারছে না। বিমানবাহিনীর জন্য দেশীয়ভাবে তৈরি তেজস যুদ্ধবিমান সরবরাহেও দেরি হচ্ছে। হিন্দুস্তান এয়ারোনটিক্স লিমিটেডের দেরি করা সরবরাহ ইতোমধ্যেই উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এদিকে চীন ষষ্ঠ প্রজন্মের স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রদর্শন করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে, অথচ ভারতের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এখনো নকশা ও উন্নয়ন পর্যায়ে। প্রযুক্তিগত এই ব্যবধান যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতকে পিছিয়ে দিতে পারে।
জনবল সংকটও এক বড় সমস্যা। এ বছরের শুরুতে সরকার জানিয়েছে, সেনাবাহিনীতে এক লাখেরও বেশি সৈন্যের ঘাটতি রয়েছে। তিন বাহিনীতে মোট ঘাটতি প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার। এত বড় জনবল ঘাটতি সশস্ত্র বাহিনীর কার্যকারিতা কমিয়ে দিচ্ছে। প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়লেও তার বড় অংশ ব্যয় হয় বেতন ও পেনশনে। ফলে আধুনিকীকরণ বা নতুন সরঞ্জাম কেনায় যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করা সম্ভব হয় না।
অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক হিসেবে অবস্থান করছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারত বৈশ্বিক অস্ত্র আমদানির ৮.৩ শতাংশ করেছে। এর মধ্যে রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে প্রধান সরবরাহকারী হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্স, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। রাফাল যুদ্ধবিমান ও স্করপিন শ্রেণির সাবমেরিন ফ্রান্স থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বছরের এপ্রিল মাসে ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য রাফাল-এম কেনার চুক্তি হয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তান চীনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, তাদের ৬১ শতাংশ অস্ত্র আমদানি চীন থেকে আসে। ফলে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে চীনের প্রভাব সরাসরি প্রতিফলিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো ক্রয় প্রক্রিয়ার জটিলতা। সরঞ্জাম কেনায় দীর্ঘসূত্রিতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেক সময় জরুরি প্রয়োজনেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। এর ফলে প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের অভাব প্রকট আকার ধারণ করছে। সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন, দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো এখন সময়ের দাবি।
গত জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত অপারেশন সিঁদুর থেকে শিক্ষা নিয়ে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাহুল আর. সিং বলেছেন, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির দেশীয়করণ ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জরুরি। বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষা, ড্রোন যুদ্ধ এবং কাউন্টার আর্টিলারি সিস্টেম দ্রুত উন্নয়ন করা প্রয়োজন। তিনি সতর্ক করেছেন যে পরবর্তী সংঘাতে ভারতের জনবসতিগুলো সরাসরি ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
এখনকার বাস্তবতায় ভারতের সামনে তিনটি বড় দিক পরিষ্কার হয়ে উঠছে। প্রথমত, বহুমুখী হুমকি আর অস্বীকার করার মতো বিষয় নয়। পাকিস্তান, চীন ও বাংলাদেশকে ঘিরে তৈরি হওয়া ত্রিমুখী চাপে ভারতকে কৌশলগতভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিরক্ষা সক্ষমতার ভেতরের ঘাটতি দ্রুত কাটাতে হবে। জনবল সংকট, পুরোনো সরঞ্জাম, প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা এবং বাজেট ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে। তৃতীয়ত, আত্মনির্ভর প্রকল্পকে কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবে কার্যকর করতে হবে। দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে প্রতিরক্ষা সক্ষমতা টেকসই হবে না।
ভারত সরকার বলছে, তারা সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং একাধিকবার উল্লেখ করেছেন, দেশ শান্তিতে বিশ্বাসী হলেও যুদ্ধসহ যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষম। তবে বাস্তবতা হলো, যুদ্ধ শুধু ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করে না; এর জন্য প্রয়োজন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষিত জনবল ও সুসংগঠিত সামরিক কাঠামো। প্রতিবেশী চীন যখন ষষ্ঠ প্রজন্মের স্টেলথ প্রযুক্তি প্রদর্শন করছে, তখন ভারত যদি এখনো পঞ্চম প্রজন্মের প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনার স্তরে থাকে, তবে ব্যবধান ক্রমশ বাড়বে।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে বহুমুখী হুমকি বাস্তব হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতা প্রকট আকার নিয়েছে। এই অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার না আনলে সামনের দিনগুলোতে ভারত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। প্রতিরক্ষা খাতে প্রযুক্তিগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সরঞ্জাম সংগ্রহে গতি আনা এবং জনবল সংকট দূর করা ছাড়া ভারতের নিরাপত্তা প্রস্তুতি কার্যকর হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ