অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফরে যাচ্ছেন। এই সফরের সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের তিনটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা তাঁর সফরসঙ্গী হচ্ছেন। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক শক্তিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে ঐক্যবদ্ধ দেখানোর জন্যই তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কেন শুধুমাত্র এই তিনটি দল, কেনো অন্যরা নয়, এবং এই সফরের রাজনৈতিক তাৎপর্য আসলে কতটা গভীর।
বাংলাদেশ বর্তমানে এক রূপান্তরপর্বে রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে, যার নেতৃত্বে আছেন মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর দায়িত্ব মূলত দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং আগামী নির্বাচনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণ কেবল কূটনৈতিক দিক থেকে নয়, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বার্তা বিশ্বকে পৌঁছে দেওয়ার একটি বড় সুযোগ।
প্রধান উপদেষ্টা সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের নেওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা হলো ভবিষ্যতের সরকার পরিচালনার দায়িত্ব যেহেতু রাজনীতিবিদদের হাতেই যাবে, তাই আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় তাদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে সরকার দেখাতে চায় যে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ঐক্যবদ্ধ। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতারাও একই বার্তা দিচ্ছেন—গণঅভ্যুত্থানের পর তারা বিভক্ত নন, বরং দেশ গঠনে ঐক্যবদ্ধ।
তবে এই অন্তর্ভুক্তির মধ্যেও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব পরিষ্কারভাবে বলেছেন, প্রতিনিধিত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দলের প্রভাব, ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা এবং সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে। তাই বিএনপি ও জামায়াতের মতো বড় রাজনৈতিক দলকে রাখা হয়েছে, যাদের রাজনৈতিক শক্তি দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে প্রভাবশালী। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি তুলনামূলক নতুন হলেও জুলাই আন্দোলনের সময়ে তারা অগ্রভাগে ছিল। ফলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই তিন দলের উপস্থিতিকে প্রতীকী এবং কার্যকর উভয় অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে সরকার।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আন্তর্জাতিক মহলে একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে চান তারা। জামায়াতে ইসলামী থেকেও বলা হয়েছে, সাধারণ পরিষদের পাশাপাশি আরও কিছু সেশনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে। এতে বোঝা যায়, সফর কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতারা আন্তর্জাতিক ফোরামে সরাসরি সম্পৃক্ত হবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত দ্বিমুখী বার্তা বহন করছে। একদিকে দেশের রাজনৈতিক ঐক্য প্রদর্শন করা হচ্ছে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ দায়বণ্টনেরও একটি প্রচেষ্টা রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটসহ আন্তর্জাতিক অনেক ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় করতে হলে রাজনৈতিক ঐক্য দরকার। আবার এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রধান উপদেষ্টা হয়তো সেই ঝুঁকি একা নিতে চাইছেন না, তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গী করে আন্তর্জাতিক আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন।
অন্যদিকে সমালোচকরা বলছেন, কেবল তিনটি দলকে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে অন্যান্য দলগুলোতে ক্ষোভ জন্মাতে পারে। এতে নির্বাচনের আগে বিভাজন আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা আছে। যদিও সরকার বলছে, প্রতিনিধিদের উপস্থিতির মধ্য দিয়েই মূলত সব দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়েছে, তবুও বাস্তবে এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অন্তত ৩০টি দল অংশ নিয়েছিল, কিন্তু সফরে জায়গা পেয়েছে কেবল তিনটি।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে শুধু মূল বৈঠক নয়, বরং সাইডলাইনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই বৈঠকগুলোয় রাজনৈতিক নেতাদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরাসরি নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার সুযোগ তারা পাবে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে তাদের বৈঠকও তাৎপর্যপূর্ণ হবে, কারণ প্রবাসী বাংলাদেশিরা অর্থনীতি ও রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
অন্যদিকে এই সফরের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসারও একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একসাথে বসে দেশের স্বার্থে অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে, তবে অভ্যন্তরীণ বিরোধ অনেকাংশে প্রশমিত হতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফর হয়তো বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ঐক্যের একটি সূচনা বিন্দু হয়ে উঠতে পারে।
তবে একইসঙ্গে ঝুঁকিও রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট এখনো বিদ্যমান। নির্বাচনের পদ্ধতি, ক্ষমতা হস্তান্তরের রোডম্যাপসহ নানা বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়েও একমত হতে পারেনি দলগুলো। এই বাস্তবতায় সফরে একসাথে থাকা যতটা প্রতীকী, বাস্তব প্রয়োগে ততটাই কঠিন হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা হয়তো হিসেব করেই এই তিনটি দলকে নিয়েছেন। বিএনপি ও জামায়াত দীর্ঘদিনের শক্তি, আর নতুন প্রেক্ষাপটে এনসিপি উঠে এসেছে। তাঁদের যুক্ত করে তিনি হয়তো মনে করছেন, যদি এদের অবস্থান এক করা যায়, তবে অন্যদেরও সামলে নেওয়া সহজ হবে।
সার্বিকভাবে এই সফরের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। এটি যেমন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে, তেমনি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশেও প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সেটি ইতিবাচক হবে নাকি নেতিবাচক, তা নির্ভর করবে সফরের ফলাফল এবং সফরের পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির ওপর। যদি রাজনৈতিক নেতারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ বার্তা দিতে পারেন, তবে তা দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার জন্য আশীর্বাদ হবে। কিন্তু যদি কেবল প্রতীকী উপস্থিতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে এটি অভ্যন্তরীণ বিভাজনকে আরও উসকে দিতে পারে।
অতএব, প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাষ্ট্র সফর কেবল কূটনৈতিক ঘটনা নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত একটি অধ্যায়। এ সফর থেকে কী বার্তা যাবে আন্তর্জাতিক মহলে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কেমনভাবে নিজেদের উপস্থাপন করবে, এবং সফরের অভিজ্ঞতা তারা দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না—এসব প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের আগামী রাজনৈতিক পথচলা। এই সফর হতে পারে ঐক্যের সূচনা, আবার বিভাজনেরও নতুন অধ্যায়। সময়ই এর চূড়ান্ত উত্তর দেবে।
আপনার মতামত জানানঃ