বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক ঋণের বিষয়টি এখন সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক দশকেরও কিছু বেশি সময় ধরে ক্রমাগত ঋণ গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী ও বিদেশি ব্যাংক থেকে নেওয়া বিভিন্ন ধরনের ঋণ মিলে দেশের বৈদেশিক দায়-দেনা নতুন রেকর্ড গড়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন শেষে বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা প্রায় ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ৩৫২ কোটি টাকার সমান। এই অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর ফলে একদিকে যেমন উন্নয়ন প্রকল্প, অবকাঠামো ও শিল্প বিনিয়োগে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে ঋণ পরিশোধ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত কয়েক বছরের মধ্যে ঋণের বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে যেখানে দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪১ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৫ সালের মধ্যে তা বেড়ে তিনগুণেরও বেশি হয়েছে। বিশেষত ২০২৩ সালের শেষ দিকে প্রথমবারের মতো দেশটি ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের মাইলফলক অতিক্রম করে। মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে সেই অঙ্ক আরও ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়ে ১১২ বিলিয়নে পৌঁছেছে। এই ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা, অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণের।
তথ্য অনুসারে, মোট ঋণের মধ্যে সরকারি খাতের অংশ ৮২ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তার জন্যই বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। জুন ২০২৫-এ সরকারি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২৩৭ কোটি ডলার, যেখানে তিন মাস আগে মার্চে এই পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৪৯২ কোটি ডলার। অর্থাৎ অল্প সময়ের মধ্যে সরকারি ঋণ প্রায় ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের ঋণ জুন শেষে ছিল ১ হাজার ৯৭ কোটি ডলার। তুলনামূলকভাবে বেসরকারি খাতের ঋণের বৃদ্ধি ধীরগতির হলেও সামগ্রিক ঋণচাপ কমাতে এর প্রভাবও সীমিত।
ঋণের চাপ বৃদ্ধির সঙ্গে মাথাপিছু দায়ও বেড়েছে অনেক। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা আনুমানিক ১৭ কোটি ৫৭ লাখ, সেই হিসাবে প্রত্যেক নাগরিকের ওপর বৈদেশিক ঋণের বোঝা প্রায় ৬৩৮ ডলার বা ৭৭ হাজার টাকার বেশি। ১০ বছর আগে যেখানে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৫৭ ডলার, সেখানে অল্প সময়ের মধ্যে তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি এখন নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ ও সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণ বাড়া সব সময় নেতিবাচক নয়। যদি ঋণ নিয়ে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা যায় এবং সেই বিনিয়োগ থেকে আয় সৃষ্টি হয়, তাহলে ঋণ অর্থনীতিকে গতিশীল করে তোলে। বাংলাদেশে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলো অনেকাংশেই বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠছে। এসব প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সমস্যা দেখা দেয় যখন ঋণ নেওয়া হয় ভোগ খাতে বা অনুৎপাদনশীল খাতে, অথবা দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে এর সুফল অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। একদিকে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় সেই তুলনায় সমানতালে বাড়েনি। ফলে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট মোকাবেলায় সরকারের নীতি ছিল একদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা, অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ বাড়ানো। তবে এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও রিজার্ভের পতন পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে, প্রবাসী আয় বাড়ছে এবং নতুন ঋণও আসছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই ঋণ দেশের অর্থনীতিকে কতটা স্থিতিশীল করবে নাকি ঋণপরিশোধের চাপ বাড়াবে—সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
ঋণ পরিশোধের বিষয়টি অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে সুদ ও মূলধন পরিশোধের জন্য প্রতিবছর বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। যখন রিজার্ভে চাপ থাকে, তখন এই পরিশোধের দায়িত্ব আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যদি রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় যথেষ্ট হারে না বাড়ে, তাহলে ভবিষ্যতে ঋণ পরিশোধের দায় মেটাতে গিয়ে সরকারকে আবার নতুন করে ঋণ নিতে হতে পারে। একে অর্থনীতিবিদরা ঋণ-চক্র বা debt trap বলে থাকেন। যদিও বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি এখনো সেই মাত্রায় পৌঁছায়নি, তবে প্রবণতা যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে ঝুঁকি বাড়তে পারে।
ঋণ বৃদ্ধির আরেকটি দিক হলো এর রাজনৈতিক প্রভাব। গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বৈদেশিক ঋণের বড় অংশ নেওয়া হয়েছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, এআইআইবি-সহ আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া এই ঋণগুলো একদিকে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি বাড়িয়েছে, অন্যদিকে সমালোচনারও জন্ম দিয়েছে। বিরোধী দল ও সমালোচকরা বলছেন, অতিরিক্ত ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বাড়তি দায় চাপিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, ঋণ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এর সুফল দেশবাসী দীর্ঘমেয়াদে ভোগ করবে।
বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ সীমার মধ্যে রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, জিডিপির ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ থাকলে সেটি বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখন ঋণ-জিডিপি অনুপাত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিচে রয়েছে। তবে ঋণের গতি যেভাবে বাড়ছে, সেটি নিয়ন্ত্রণ না করলে কয়েক বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে।
বেসরকারি খাতের ক্ষেত্রে বিদেশি ঋণের প্রবণতা ভিন্ন রকম। অনেক উদ্যোক্তা কম সুদে বিদেশি ঋণ নিয়ে শিল্প সম্প্রসারণ বা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছেন। এতে শিল্পায়নের গতি বাড়ছে, কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। তবে অনেক সময় এসব ঋণও ঝুঁকি তৈরি করে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার বেড়ে গেলে বা মুদ্রার বিনিময় হার অস্থিতিশীল হলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়ে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক ঋণ কোন পথে যাবে—উন্নয়নের সহায়ক হবে নাকি ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে? উত্তর নির্ভর করছে সরকারের নীতি, ঋণের ব্যবহার ও অর্থনীতির সামগ্রিক গতিপ্রকৃতির ওপর। যদি ঋণ উৎপাদনশীল খাতে যায়, যদি দুর্নীতি ও অপচয় নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং যদি রপ্তানি ও প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো যায়, তাহলে ঋণ দেশের অর্থনীতিকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু উল্টোটা হলে ঋণই হয়ে উঠতে পারে অর্থনীতির জন্য বোঝা।
বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা, অন্যদিকে ঋণের দায়। সঠিক পরিকল্পনা, বিচক্ষণতা ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারলে ঋণ বাংলাদেশের জন্য সুযোগ হয়ে উঠবে। কিন্তু পরিকল্পনার ব্যর্থতা হলে এবং অযথা ঋণনির্ভরতা বাড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব আগামী প্রজন্মের কাঁধে চেপে বসতে পারে। তাই এখনই প্রয়োজন কৌশলগত দৃষ্টি, স্বচ্ছতা এবং ঋণের কার্যকর ব্যবস্থাপনা।
আপনার মতামত জানানঃ