ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে সোমবার এক উত্তাল দৃশ্যের জন্ম দিল দিল্লির রাজপথ। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও তাঁর বোন, কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রকে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার মুহূর্তটি শুধু ভারতীয় গণমাধ্যমেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও দৃষ্টি কাড়ে। ঘটনা ঘটে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া ব্লক’-এর একটি প্রতিবাদ মিছিল ঘিরে, যা নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক ভোটার তালিকা সংশোধনের নীতি ও প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে। বিরোধীদের অভিযোগ, এই নীতি ক্ষমতাসীন বিজেপিকে সুবিধা দেবে এবং লক্ষ লক্ষ গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার কেড়ে নেবে।
সকালে ঠিক সাড়ে এগারোটায় নয়াদিল্লির পার্লামেন্ট ভবনের মকর দ্বার থেকে ইন্ডিয়া ব্লকের নেতারা মিছিল শুরু করেন। গন্তব্য ছিল নির্বাচন কমিশনের সদর দপ্তর ‘নির্বাচন সদন’। ‘ভোট চুরি’ বন্ধ করো—এই স্লোগানে মুখর মিছিলে কংগ্রেসের দুই শীর্ষ নেতা ছাড়াও এনসিপি-র শরদ পাওয়ার, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব, শিবসেনা (ইউবিটি)-র সঞ্জয় রাউত, তৃণমূলের সাগরিকা ঘোষসহ লোকসভা ও রাজ্যসভার বহু বিরোধী সাংসদ অংশ নেন। বিহারের বিশেষ ভোটার তালিকা পুনর্নির্মাণ (Special Intensive Revision বা SIR) প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ ছিল দীর্ঘদিনের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ।
বিরোধীদের মূল আপত্তি ছিল, আগে ভোটার হিসেবে আধার কার্ড বা ভোটার আইডি একাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু নতুন নিয়মে এগুলো এককভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। পরিবর্তে জন্মসনদ, পাসপোর্ট, বন অধিকার সনদ বা সরকারি শিক্ষা সনদের মতো ১১টি আলাদা নথির মধ্যে যেকোনো একটি দিতে হবে। বিরোধী শিবিরের আশঙ্কা, বিহারের গরিব, গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে এই নথি পাওয়া প্রায় অসম্ভব, ফলে তারা ভোটাধিকার হারাবে। রাহুল গান্ধীর ভাষায়, “এ লড়াই রাজনৈতিক নয়—এটা সংবিধান বাঁচানোর লড়াই। এক ব্যক্তি, এক ভোট—এই নীতির সুরক্ষাই আমাদের উদ্দেশ্য।”
তবে মিছিল সংসদ ভবন থেকে বেরোতে না বেরোতেই দিল্লি পুলিশের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয়। পুলিশের দাবি, এই মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য আনুষ্ঠানিক অনুমতি নেওয়া হয়নি। ‘ট্রান্সপোর্ট ভবন’-এর কাছে ব্যারিকেড বসিয়ে পুলিশ মিছিল থামিয়ে দেয়। ততক্ষণে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে—অখিলেশ যাদব ব্যারিকেড টপকে যাওয়ার চেষ্টা করেন, মহিলা সাংসদ মহুয়া মৈত্র ও সঞ্জনা জাটাভ অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুপুর পৌনে একটার দিকে পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হয়, যখন পুলিশ রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র, সঞ্জয় রাউত, সাগরিকা ঘোষসহ অন্তত ৩০ জন নেতাকে আটক করে। তাঁদের সংসদ স্ট্রিট পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী আটক হওয়ার আগে সাংবাদিকদের বলেন, “সরকার ভয় পেয়েছে। তারা জনগণের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না, তাই ভয় দেখানোর পথ নিয়েছে।” বিরোধীদের মতে, এই পুরো প্রক্রিয়া আসন্ন বিহার বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে সাজানো এক রাজনৈতিক পরিকল্পনা, যা বিজেপির বিজয় নিশ্চিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন অবশ্য দাবি করেছে, এই উদ্যোগ ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা ও সঠিকতা নিশ্চিত করার জন্য নেওয়া হয়েছে।
মিছিল ভেঙে দিলেও আন্দোলন থামেনি। কংগ্রেস ঘোষণা করেছে, আগামী ১৭ আগস্ট থেকে রাহুল গান্ধী বিহারে ‘মতদাতা অধিকার যাত্রা’ শুরু করবেন, যা চলবে দুই সপ্তাহ। এই যাত্রার মাধ্যমে তিনি গ্রাম-শহরে গিয়ে মানুষকে ভোটাধিকার রক্ষার গুরুত্ব বোঝাবেন। বিরোধীরা বলছে, এটি শুধু একটি রাজ্য নয়—পুরো দেশের গণতন্ত্রের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ লড়াই।
আজকের এই ঘটনার পর ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। একদিকে ক্ষমতাসীন বিজেপি ভোটার তালিকা সংস্কারকে স্বচ্ছতার পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরছে, অন্যদিকে বিরোধীরা একে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র বলছে। রাস্তায় নেমে আটক হওয়া শীর্ষ নেতাদের দৃশ্য ভারতের রাজনৈতিক লড়াইকে আরও তীব্র করেছে, এবং মনে করিয়ে দিয়েছে যে ভারতের গণতন্ত্রে ভোটের অধিকার শুধু একটি সাংবিধানিক বিধান নয়—এটি জনগণের হাতে ক্ষমতার চাবিকাঠি।
আপনার মতামত জানানঃ