মসলা ছাড়া রান্নার কথা ভাবাই যায় না, সুগন্ধি মসলা ছাড়াতো নয়ই। আর এই সুগন্ধি মসলার তালিকায় প্রথম সারিতেই দারুচিনির নাম উঠে আসে। মসলার জগতে দারুচিনি একটি প্রসিদ্ধ নাম। এটা ছাড়া যেন, যে কোনো শাহী রান্না অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যেমন পোলাও, কোরমা, রোস্ট, মাংস, বিরিয়ানি, সেমাই ইত্যাদি রান্না করার কথা ভাবাই যায় না।
দারুচিনি আমাদের রান্নার অনেকখানি জুড়ে আছে। রান্নার স্বাদ ও সুগন্ধ বাড়াতে এর জুড়ি নেই। দারুচিনি সুগন্ধযুক্ত একটু ঝাঁঝালো মসলা। অনেকের ধারণা আমাদের এই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ভেষজ দারুচিনি। এর স্বাদ এবং সুগন্ধির জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রায় বিশ্বের প্রত্যেক দেশেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দারুচিনির বৈজ্ঞানিক নাম: Cinnamomum verum; এরা Lauraceae পরিবারের সদস্য।
দারুচিনির অতীত ইতিহাস খুব সমৃদ্ধ। এটা অতি প্রাচীনকালের একটি মসলা। প্রায় চার হাজার বছর আগে বিশ্বে দারুচিনির সন্ধান পাওয়া যায় মিসরে। সেখান থেকে আস্তে আস্তে আরবদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। আরবরা সেই সময়ে স্থলপথে বাণিজ্যের জন্য দারুচিনি ইউরোপে নিয়ে যেত, এবং তাদের কাছে উচ্চ মূল্যে বিক্রয় করতো। একমাত্র ইউরোপিয়ান ধনীরা এই দারুচিনি ক্রয় করতে পারতো। কারণ এ মসলার দাম প্রাচীন মিসরে সোনার চেয়েও বেশি ছিল! তারা দারুচিনি দিয়ে পারফিউম তৈরি করতো এবং শীতের জন্য মাংস সংরক্ষণ করে রাখতো।
ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন, তিনশ পঞ্চাশ গ্রাম দারুচিনির মূল্য সে সময়ে পাঁচ কেজি রূপার দামের সমান ছিল। অবাক হচ্ছেন? দারুচিনির বহুমূল্য অবস্থান থেকে আজকের আটপৌরে জীবনযাত্রা অবাক করার মতোই। দারুচিনির এই আকাশছোঁয়া দামের জন্য অবশ্য ঐতিহাসিকেরা মূলত দায়ী করেন এর দুর্লভতাকে।
ইউরোপিয়ানরা অনেক চেষ্টা করেও আরবদের কাছ থেকে জানতে পারেনি তারা কীভাবে দারুচিনি পেত। আরবরা তাদের কাছে নানা ধরনের গল্প বানিয়ে বলতো। ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করার পর রানি ইসাবেলাকে জানায়, সে আমেরিকায় দারুচিনির সন্ধান পেয়েছে; তার নমুনাও পাঠায় তাকে। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়, ওটা আসলে দারুচিনি ছিল না।
১৫১৮ সালে পর্তুগিজ বণিকগণ সিংহল অর্থাৎ এখনকার শ্রীলঙ্কায় এসে দারুচিনি আবিষ্কার করে। তারা সিংহল রাজ্য দখল করে দারুচিনির বাণিজ্য নিজেদের দখলে নেয়। এরপর ১৬৩৮ সালে ইউরোপিয়ানরা পর্তুগিজ বণিকদের উৎখাত করে দারুচিনির ব্যবসা দখল করে নেয়। এভাবে ইউরোপিয়ান আর পর্তুগিজদের মধ্যে দখল আর বেদখলের খেলা চলতে থাকে ১৫০ বছর ধরে। এরপর ১৭৮৪ সালে সিংহল পর্তুগিজদের যুদ্ধে পরাজিত করে। কিন্তু আবার ব্রিটিশরা দখল করে নেয়।
অবশেষে ১৮০০ সালে তারা ব্রিটিশদের উৎখাত করে নিজেরা দারুচিনির ব্যবসা শুরু করে। এভাবে শ্রীলঙ্কা থেকে সারা বিশ্বে দারুচিনির চাষ ও ব্যবসা ছড়িয়ে পরে। আরবরা যেহেতু স্বীকার করেনি ওরা কোথা থেকে দারুচিনি পেত, সম্ভবত সেই কারণে দারুচিনির আদিবাস শ্রীলঙ্কা বলা হয়ে থাকে। আজকাল ইন্দোনেশিয়া, ভারত,বাংলাদেশ ও চীন প্রভৃতি দেশে প্রচুর পরিমাণে দারুচিনি উৎপাদিত হচ্ছে।
দারুচিনি চিরসবুজ বৃক্ষ। স্বাভাবিক পরিবেশে এই বৃক্ষের উচ্চতা ১০ থেকে ১৬ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেখতে কিছুটা তেজপাতা বৃক্ষের মতো এই বৃক্ষের ছাল মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাতা বেশ লম্বাটে, মোটা, কিছুটা চামড়ার মতো, তীক্ষ্ণাগ্র, উপরে উজ্জ্বল সবুজ, নিচের দিকে হালকা। পাতার প্রধান শিরামূল থেকে মধ্য শিরা পর্যন্ত স্পষ্ট এবং সংখ্যায় তিন থেকে পাঁচটি। এর ফুল বড় গুচ্ছ আকারে ফোটে,ফল লম্বাটে, বেগুনি এবং ভেতরে একটি মাত্র বিচি থাকে। দারুচিনির বাকলে ‘সিনামাল ডিহাইড’ থাকে আর সেটাই ঘ্রাণের কারণ। এর পাতায় থাকে ‘ইউজিনল’।
দারুচিনি সাধারণত দু’ধরনের হয়ে থাকে, সিলোন বা মিষ্টিকাঠ দারুচিনি এবং চাইনিজ বা ঝুটা দারুচিনি। সিলোন বা মিষ্টিকাঠ দারুচিনি তীব্র সুগন্ধি এবং বেশ মিস্টি যুক্ত, এর ছাল কালচে খয়েরি রঙের পাতলা এবং মসৃণ। চাইনিজ বা ঝুটা দারুচিনি কম সুগন্ধি এবং মিস্টি যুক্ত, এর ছাল লালচে বাদামি রঙের পুরু এবং খসখসে। বিভিন্ন ধরনের মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু সহ্য করতে পারে দারুচিনি গাছ। বেলে দো-আঁশ মাটি দারুচিনি চাষের জন্যে ভালো। দারুচিনির চারা সাধারণত বীজ থেকেই হয়ে থাকে।
দারুচিনি গাছ কাটিং বা গুটিকলম করেও চারা করা যায়। ৫/৬ বছর বয়সী গাছ হতে নিয়মিত ছাল ছাড়াবার ডাল পাওয়া যায়। দারুচিনি গাছ থেকে বছরে একাধিকবার ডাল কাটা যায়, তবে সবচেয়ে ভালো হয় একবার ডাল কাটলে। এপ্রিল, মে মাসে সাধারণত ডাল কাটা হয়। এই ডাল ১ থেকে ৩ সেমি ব্যাসের এবং এক হতে দেড় মিটার লম্বা ডাল কাটলে ভালো হয়। এ ধরনের ডাল হতে উন্নতমানের ছাল পাওয়া সম্ভব। শুকনা পাতা ও ছাল হতে তেল নিষ্কাশন করা হয়। এর তেল ঔষধি গুণে ভরপুর।
আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় দারুচিনির ব্যবহার করা হয়ে থাকে নানা ধরনের রোগ উপশমের জন্য। বাতের ব্যথা, কাশি, শ্বাসকষ্ট, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগে দারুচিনি খুবই উপকারী। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই রোগগুলোর ঔষধ হিসেবে দারুচিনির ব্যবহার করা হয়। দারুচিনিতে অসংখ্য ঔষধি গুণাগুণ বিদ্যমান।
আপনার মতামত জানানঃ