একের পর এক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এশিয়ার পরাশক্তিধর দেশ পাকিস্তান। কিছুদিন আগেই ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে উৎখাতে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট দেশটিকে প্রায় অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ইমরানের পতনের পর শাহবাজ শরিফ নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরু হয়েছে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট।
শ্রীলঙ্কার পথেই হাঁটছে যেন দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তান! দিন যত যাচ্ছে, বিদেশি ঋণে জর্জরিত দেশটির অর্থনীতি তত বেহাল হচ্ছে। রিজার্ভ ফাঁকা হতে হতে একেবারে শেষের পথে রয়েছে।
পাকিস্তানের অর্থনীতির সব সূচক এখন নেতিবাচক। দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত প্রতিদিন কমছে। মূল্যস্ফীতি আকাশচুম্বী, কমছে প্রবাসী আয়। মুদ্রার মান কমে এযাবৎকালে সর্বনিম্ন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। চলতি তহবিলেও ঘাটতি অনেক।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে ঋণ চেয়েও পড়েছে কঠিন সব শর্তের মুখে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির জন্য অধ্যাদেশে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। বন্ধুপ্রতিম দেশের কাছেও আর্থিক সাহায্য চাচ্ছে পাকিস্তান সরকার। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তো আছেই। এ কারণে দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের অবনতি ঘটেছে। সংকট মোকাবিলা কঠিন করেছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
বিশ্বসেরা অর্থনীতি বিশ্লেষক সংস্থা মুডিস, ফিচ ও এসঅ্যান্ডপি এর রেটিং পাকিস্তানের নাজুক অর্থনীতির সূচককে আরও নিচে নামিয়ে দিয়েছে।
দেউলিয়া হবার শুরুতে যে অবস্থাটি শ্রীলঙ্কার হয়েছিল ঠিক সেই পথেই এখন হাঁটছে বলে উঠে এসেছে রেটিং সংস্থাগুলোর বিশ্লেষণে।
ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি আর জ্বালানির দাম এবং বিভক্ত রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে গত কয়েক মাস ধরেই অর্থনীতিকে সচল রাখতে লড়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। তাই বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর অন্যতম এই দেশটি শিগগিরই ঋণ খেলাপি হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক ডেইলি টাইমস এর উদ্ধৃতি দিয়ে রেটিং এজেন্সিগুলো বলছে, দেশটির অর্থনৈতিক পতন মোকাবিলায় অর্থ মন্ত্রণালয় যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেয় তবে এটিকে আগের রেটিংয়ে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। তবে এটি কীভাবে করা হবে- তা এখন বড় প্রশ্ন।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মাত্র দেড় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো ডলার মজুত আছে। এ বছরও দেশটির ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল। নাজুক এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইএমএফ এর কাছে ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চাইছে পাকিস্তান। এ পরিমাণ অর্থ দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এভাবে আর কতদিন চলবে!
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তান নিয়ে বিনিয়োগকারীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহযোগিতা না পেলে দ্বিতীয়বারের মতো ঋণ খেলাপি হতে পারে পাকিস্তান।
আরেকটি বিষয় হলো- রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্যও পাকিস্তান আগুনের মুখে পড়েছে। রাজনৈতিক অভিজাতরা যদি তাদের তিক্ত ও কুৎসিত যুদ্ধকে কিছুক্ষণের জন্য থামাতেন এবং অর্থনীতিতে মনোনিবেশ করতে সক্ষম হন তবে হয়তো দেশটি সুড়ঙ্গের শেষে একটি উজ্জ্বল আলো দেখতে পাবে।
দেউলিয়া হবার শুরুতে যে অবস্থাটি শ্রীলঙ্কার হয়েছিল ঠিক সেই পথেই এখন হাঁটছে বলে উঠে এসেছে রেটিং সংস্থাগুলোর বিশ্লেষণে।
আমেরিকান ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের রেটিং পাকিস্তানের ঋণের দৃষ্টিভঙ্গিকে নেতিবাচক দিকে নিয়ে গেছে। বাজারগুলো মনে করছে, পাকিস্তান শিগগিরই ঋণ খেলাপি হয়ে শ্রীলঙ্কার পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার এসঅ্যান্ডপি এর বিবৃতিতে বলা হয়- দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে সহায়তা দ্রুত হ্রাস পেলে বা ব্যবহারযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমে গেলে পাকিস্তানকে আরও অবনমিত করা হতে পারে।
সম্প্রতি নিজেদের মুদ্রার রেকর্ড পরিমাণ মান কমতে দেখেছে পাকিস্তান। ডলারের বিপরীতে দেশটির রুপি একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ অবস্থায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তানও সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় এখন যে সংকট চলছে, পাকিস্তানও সেই পথেই ধাবিত হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবেদরা। তারা বলছেন, পাকিস্তানের অর্থনীতিও শ্রীলঙ্কার মতো ধুঁকছে। শ্রীলঙ্কার মতোই ভুল নীতি ও দুর্নীতির কারণে অর্থনীতি সংকটে পড়েছে পাকিস্তান। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার মতো পাকিস্তানও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সংকটে পড়েছে। এতে খাদ্য ও জ্বালানির মতো নিত্যপণ্যের আমদানি কমাতে হয়েছে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কার মতোই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরির পথ তৈরি করে দিয়েছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করলে শ্রীলঙ্কার মতো পাকিস্তানের মানুষও রাস্তায় নামবে বলে ধারণা।
শ্রীলঙ্কার মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন জ্বালানি ও খাদ্যের মতো নিত্যপণ্যের সংকটে। দীর্ঘ লাইনে কয়েক দিন দাঁড়িয়ে থেকেও জ্বালানি না পেয়ে মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এর প্রতিবাদে তাঁরা রাস্তায় নেমে আসেন। বিক্ষোভ দমনের সব রকমের চেষ্টা করে সরকার। এতে মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়ে। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন। বিক্ষোভকারীদের ঢুকতে দেখে প্রেসিডেন্ট পালিয়ে যান। দেশত্যাগ করে পদত্যাগ করেন।
প্রেসিডেন্টের পদত্যাগে তার অনুগত প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে পার্লামেন্ট। কিন্তু এতে রাজনীতি ও অর্থনীতির অচলাবস্থা কাটেনি। পাকিস্তানের রাজনীতিতেও সংকট চলছে। ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে স্থিতিশীল একটি সরকার থাকার কথা থাকলেও পাকিস্তানে এখন তা নেই। সামনের দিনগুলোয় অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কায় সংকট শুরুর আগে যেসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও একই পথে আছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ