ছাত্রলীগ এখন কেবল ছাত্রসমাজের কাছে এখন আতঙ্কের নাম নয়, গোটা দেশের নিকট আতঙ্কের নাম। হত্যা ছাড়াও চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণসহ আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে৷ এবার মুক্তিপণ চেয়ে সাতক্ষীরার তালায় এক কলেজছাত্রকে মারপিট ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।
যাদের বিরুদ্ধে তাকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে তারা হলেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তালার মাঝিয়াড়া গ্রামের সৈয়দ আকিব, উপজেলা শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হরিশচন্দ্রকাটি গ্রামের সৌমিত্র চক্রবর্তী, তালা গার্লস স্কুল এলাকার বাসিন্দা ছাত্রলীগ কর্মী জে. আর সুমন, তালার মহান্দি গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী মো. জয় ও তালা সদরের ছাত্রলীগ কর্মী নাহিদ হাসান উৎস।
স্থানীয় সূত্র জানায়, জিপিএ-৫ পেয়ে সদ্য এসএসসি পাশ করা এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র তালা উপজেলার জাতপুর গ্রামের শোয়েব আজিজ তন্ময়কে রোববার সন্ধ্যায় তার কয়েকজন পরিচিত বন্ধু মোবাইল ফোনে ডেকে নেয়। পরে তাকে তালার সরকারি কলেজের হোস্টেলের একটি কক্ষে নিয়ে তাকে বিবস্ত্র করা হয়।
এ সময় তার মাথার চুল কেটে দেওয়া হয় এবং তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তার কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে সৈয়দ আকিব ও সৌমিত্রসহ ৫ জন। তারা দীর্ঘক্ষণ ধরে আটকে রেখে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এই চাঁদার টাকা নিয়ে চাপাচাপি করতে থাকে। খবর পেয়ে তন্ময়ের স্বজনরা তাকে অপহরণকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার করে আনেন।
নির্যাতনের শিকার কলেজছাত্র শোয়েব আজিজ তন্ময় তালা সদরের জাতপুর গ্রামের শেখ আজিজুর রহমানের ছেলে। চলতি বছর তিনি জাতপুর টেকনিক্যাল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন।
কলেজছাত্র শোয়েব আজিজ তন্ময় অনলাইন দৈনিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ কর্মী নাহিদ হাসান উৎস আমার পূর্বপরিচিত। তালা বাজারে যাতায়াত সুবাদে তার সঙ্গে পরিচয়। রোববার দুপুরে আমাকে ফোন করে তালা কলেজ এলাকায় ডেকে নেয় উৎস। এরপর কলেজের পশ্চিম পাশের একটি রুমে নিয়ে যায়।
‘সেখানে টানা ৫ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন চালায় আকিব, সৌমিত্র, সুমনসহ অন্যরা। হাত-পায়ে নির্মমভাবে মারপিট করে মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। এরপর বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে। তারপর বাড়িতে ফোন করে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তারা।’
এ সময় তার মাথার চুল কেটে দেওয়া হয় এবং তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তার কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে সৈয়দ আকিব ও সৌমিত্রসহ ৫ জন। তারা দীর্ঘক্ষণ ধরে আটকে রেখে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এই চাঁদার টাকা নিয়ে চাপাচাপি করতে থাকে।
তন্ময় আরও বলেন, ‘যে রুমের মধ্যে আমাকে আটকে রেখেছিল সেটি সম্ভবত কলেজের ছাত্রাবাস কক্ষ। সেটি কলেজের মধ্যেই অবস্থিত। ওই রুমের মধ্যে মারপিট করার জন্য বেল্ট, লাঠিসোঁটা এখনও রয়েছে। ওখানে নিয়ে টর্চার করে বলে মনে হয়েছে।’
তন্ময়ের বাবা আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে দিল। তন্ময়ের সঙ্গে ওদের কোনো বিরোধ নেই। একসঙ্গে পড়েও না। হঠাৎ ডেকে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। আমার স্ত্রীর কাছে রোববার বিকেলে ফোন করে ছেলেকে ফিরে পেতে দুই লাখ টাকা নিয়ে কলেজের সামনে যাওয়ার কথা বলেছে তারা।’
আজিজুর রহমান আরও বলেন, ‘টাকা চেয়ে যখন ফোন করা হয় তখন আমার ছেলে কৌশলে নিজের ফোন থেকে তার চাচাতো ভাই জুবায়ের আহমেদকে বার্তা পাঠায়। সেই বার্তায় তন্ময়ের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে ছুটে যায় জুবায়েরসহ অন্যরা। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানান, ছাত্রলীগের নেতা আকিবের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। নতুন করে মেয়েটির সম্পর্ক গড়ে উঠে তন্ময়ের সঙ্গে। তন্ময়ের ওপর প্রতিশোধ নিতে আকিব তাকে ডেকে এনে মারপিট করে ও মাথা টাক করে দেয়।
তালা সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর শেখ হুমায়ূন কবীর জানান, পাঁচ দিন আগে কলেজে ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে গেছেন বেশিরভাগ ছাত্র। সেখানে কোনো রুমে নিয়ে কাউকে নির্যাতনের কথা তিনি শোনেননি।
এদিকে, তালা হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কলেজছাত্র শোয়েব আজিজ তন্ময়কে সোমবার (২৫ এপ্রিল) বেলা ১২টায় বাড়িতে নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হুমকি ধামকি দিচ্ছে বলে জানান তন্ময়ের বাবা আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। গত রাতে থানাতেও আমাকে মামলা না করার জন্য হুমকি দিয়েছিল।
সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনাসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার আলোচনায় আসে ছাত্রলীগ। মাদক ব্যবসা, টেন্ডার-বাণিজ্য, পুলিশকে মারধরসহ একের পর এক নানা অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ যে আদর্শ ও নীতিতে একটি সংগঠনে রুপ নিয়েছিল সেই আদর্শ এখন আর নেই। বিশ্লেষকরা বলেছেন, আদর্শের চর্চা না থাকার ফলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা দুর্নীতিসহ নানান অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের এই সর্বগ্রাসী নতুন রাজনৈতিক আদর্শ ও ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে যাকে পারো তাকে ধরো, আওয়ামী লীগ করো নীতিতে চলতে গিয়ে ছাত্রলীগ আর আগের মতো আদর্শিক ছাত্রলীগ হতে পারছে না। তারা মনে করেন, ছাত্রলীগ এখন আর ছাত্রলীগের সঙ্গে আদর্শিকভাবে নেই। তারা কোনো ভাই বা সিন্ডিকেটের রাজনীতি করছে। তাদের ভাষ্যমতে, সিন্ডিকেট হলো তারাই, যারা ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে অর্থ, সম্পদ, বিত্ত, বৈভব বানিয়েছে। আর ছাত্রলীগও তাদের ব্যবহার করে ধান্দার রাজনীতি করছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য দিনদিন চাউর হয়ে উঠছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার চূড়ান্তে বসবাস করেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আগ্রহবোধ না করায় তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে চলেছে। ছাত্রলীগের এই আইনের উর্ধে চলে যাওয়ার পেছনে অবশ্য রাজনৈতিক নেতা কুৎসিত হাতের ভূমিকা রয়েছে। তারা বলেন, ছাত্রলীগ সংগঠনটির ছাত্রদের ধীরে ধীরে উগ্র এবং একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে রুপদানের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক মদদ ও উস্কানি। এ বিষয়ে প্রশাসনের জরুরি পদক্ষেপ হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩৪
আপনার মতামত জানানঃ