করোনা মহামারিকালে রাষ্ট্রের নানা সঙ্কটের মধ্যেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ক্রসফায়ার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বছরের বিভিন্ন সময়ে। এ সময় করোনা মহামারির কারণে রাষ্ট্রের নানা সঙ্কটের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
বর্তমান সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ২০১৯ সাল থেকে পরবর্তী তিন বছরে ৭১টি গুমের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)। এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
সিজিএসের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশক বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সর্বমোট ৫২২ ব্যক্তি গুমের শিকার হন। সে হিসাবে আওয়ামী শাসনে মোট ৫৯৩ জন গুমের শিকার হন।
গবেষণার বরাত দিয়ে সিজিএস বলছে, এই তিন বছরে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা গুমের শিকার হয়েছেন সবচেয়ে বেশি।
কোথায় আছেন তারা? বাংলাদেশে গুমের ঘটনা’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে আজ সোমবার(২১ মার্চ) এ গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে সিজিএস। ওয়েবিনারে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন গবেষণা কার্যক্রমের মুখ্য গবেষক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং সিজিএসের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ড. আলী রীয়াজ।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৭১টি গুমের ঘটনা ঘটে। সেগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৭১ জনের মধ্যে ১৬ জন এখনো নিখোঁজ এবং ৫ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া ২২ জনকে পরবর্তীতে আটক কিংবা গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। ২৩ জন গুম হওয়ার পর ফেরত এসেছে এবং ৫ জন সম্পর্কে কোন তথ্য জানাতে পারেনি সিজিএস।
তবে যে ৫১ জনের পেশা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে তাতে দেখা গেছে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা গুমের শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এই দুই পেশার ১১ জন করে গুমের শিকার হয়েছেন।
সিজিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫২টি গুমের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়া এলিট ফোর্স র্যাব ২১টি এবং ডিবি ১৬টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সিআইডিসহ নানা বাহিনীর জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ২৬টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। আর গত বছরের জুনে সবচেয়ে বেশি ৮ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন।
তবে যে ৫১ জনের পেশা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে তাতে দেখা গেছে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা গুমের শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এই দুই পেশার ১১ জন করে গুমের শিকার হয়েছেন।
ওয়েবিনারে আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ নুর খান বলেন, ‘এমনও ঘটনা আছে যে মিরপুরে র্যাবের গাড়িতে করে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং সিসিটিভির ফুটেজও রয়েছে। তারপরও পরবর্তীতে তা স্বীকার করা হয়নি। ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২০২৩ সালে একটা নির্বাচন দেখব। নির্বাচন আসার আগে এ ধরনের তৎপরতা আবারও দেখা যেতে পারে। সেখানে জঙ্গি ইস্যু দেখানোর চেষ্টা হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ গুমের শিকার হতে পারেন। তাই এটা মোকাবিলায় আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জোরদার করা উচিত।’
ওয়েবিনার অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। প্রতিবেদনে গুম হওয়া ৭১ ব্যক্তির নাম, কখন গুম হয়েছেন, বর্তমানে কি অবস্থায় আছেন ইত্যাদি তথ্য তুলে আনা হয়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারকে হয়রানি বন্ধ করে তাঁদের আইনি সহায়তা দেওয়াসহ ৫ দফা পরামর্শ দেওয়া হয় ওই প্রতিবেদনে।
এর আগে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, গত তিন বছরে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, কথিত বন্ধুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারসহ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৬টি জেলার ৫৯১ জন।
সিজিএস বলছে, এই ৫৯১ জনের মধ্যে ৮৬ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে কথিত বন্ধুকযুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যরা সরাসরি এসব ঘটনায় জড়িত ছিল বলে মন্তব্য করেছে সিজিএস।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের ডিসেম্বরে পর্যন্ত দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৯১ ব্যক্তি। এর মধ্যে ২০২০ সালের জুলাইয়ে সবচেয়ে বেশি ৪৯ জন মারা গেছে। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যার ৮৬ দশমিক ৬৩ শতাংশই ছিল বন্ধুকযুদ্ধ। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৬টিতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কক্সবাজার জেলায় মারা গেছে সবচেয়ে বেশি ২৩৮ জন। আর ঢাকাতে এরকম ঘটনা ঘটেছে ৫৮ জনের সঙ্গে।
এদিকে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন স্বজনরা। প্রিয়জনের খোঁজ করতে গিয়ে হয়রানি, ভয়ভীতিসহ নানা অমানবিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্নেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গুম-নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা অনেকটা কমে এসেছে। তবে আগের ঘটনাগুলোর তদন্ত করে রহস্য উন্মোচন না হওয়ায় আইনের শাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
আইনজ্ঞরা বলেন, ‘যে কোনো দেশের নাগরিকের জীবন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রধানতম দায়িত্ব। এ ধরনের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বলছে, আমরা কিছু জানি না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিখোঁজ হওয়ার অনেকদিন পরে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। রাষ্ট্রের এ আচরণ সংবিধান পরিপন্থি। বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে সেগুলোর পরিপন্থি। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিশেষত হিউম্যান রাইট ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) কয়েক বছর ধরে এসব বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রকে ভর্ৎসনা করছে। আমরা যতই আমাদের ভাবমূর্তি নিয়ে গর্ববোধ করি, এ গুমের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তিকে বিপদগ্রস্ত করছে।’
অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত খুন ও হেফাজতে নির্যাতন ও ন্যায়বিচারের সুযোগহীনতার মতো বিষয়গুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নৃশংসতা ও চরম অপরাধগুলোর অন্যতম। বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত হয় না, বরং পরস্পর সম্পৃক্ত; একটি অপরটিকে প্রভাবিত করে এবং চূড়ান্তভাবে আইনের শাসনকে বিপন্ন করে তোলে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য গুমকে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ আগে যেমন হোটেল, রেস্টুরেন্টে, বাসে, ট্রেনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো, তাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নিয়ে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এমন কোনো আলোচনা হতে দেখি না। তার একটা বড় কারণ হচ্ছে গুমের মত ঘটনা এমন একটা অবস্থায় মানুষকে নিয়ে গিয়েছে মানুষ আর এখন নিজেকে নিরাপদ ভাবছে না।
আইনজ্ঞরা বলছেন, যদি কোনো ব্যক্তি সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন, যদি কারো ফেসবুক স্ট্যাটাস বা কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকার বিব্রত হয়, তাহলে তাকে সতর্ক করা কিংবা তাকে শাস্তি দেয়ার আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। রাষ্ট্রের যে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধেই মামলা হতে পারে এবং তার দল ও মত যাই হোক, তার বিচারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এমনকি, তাকে জিজ্ঞাসাবাদেরও আইন রয়েছে। কিন্তু এরপরও কেন মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে সেটা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ‘নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। নিখোঁজের কোনো অভিযোগ আসামাত্র তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। নিরপেক্ষভাবে তার তদন্ত করতে হবে। ভিকটিম পরিবারকে তার স্বজনের অবস্থানের বিষয়ে জানাতে হবে।’
তারা বলেন, বিগত এক দশকে দেশ এমন অবস্থার সাক্ষী যেখান থেকে গণতন্ত্র ক্রমেই সরে গেছে। এমন এক শাসনব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে, যা গণতন্ত্রের যেকোনো রূপ থেকেই অনেক দূরে। ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। দেশ শাসনে এখন বলপ্রয়োগের বাহিনীগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির বিষয়টি অনেক দূরে চলে গেছে। যদিও এগুলোকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় কি না, তাও একটি প্রশ্ন।
আরও বলেন, সুষ্ঠূ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহির যে প্রক্রিয়া, তা যখন কার্যত অবসিত হয়েছে, তখন আরও বেশি দরকার হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জবাবদিহির চেষ্টা করা। কিন্তু, গুমের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) কথা বলতে পারার ব্যর্থতার মাধ্যমেই জবাবদিহি না থাকায় তৈরি হওয়া সংকটের গভীরতা বোঝা যায়।
তারা বলেন, গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার সময়ে এটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার যে, গুমের বিষয়টি শাসনব্যবস্থা ও জবাবদিহির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত; আর এটা খুব স্পষ্টভাবে বলা যে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৯
আপনার মতামত জানানঃ