বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। লন্ডনের চ্যাথাম হাউজে আয়োজিত একটি সংলাপে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগকে আদৌ রাজনৈতিক দল বলা যায় কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন।” যদিও তিনি এও জানান যে, দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি, বরং দেশের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে আপাতত তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে—যতক্ষণ না আইনি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের বক্তব্য বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কাছে দেশের রাজনীতিকে অনিরাপদ বা অনিশ্চিত হিসেবে তুলে ধরতে পারে, যা আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে। পাশাপাশি, এতে রাজনৈতিক সমঝোতার সুযোগ কমে এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও তীব্র হতে পারে। একজন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে, বিদেশে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় আরও সংযত, কৌশলী এবং তথ্যভিত্তিক হওয়াই বেশি কাম্য।
এদিকে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেন, তার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সাংবাদিকদের স্বাধীনতা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি প্রসার পেয়েছে। সংবাদমাধ্যম এখন মুক্তভাবে কাজ করতে পারছে বলে দাবি করেন তিনি।
এ সময় তিনি আরও জানান, জুলাই মাসে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ‘জুলাই চার্টার’ ঘোষণা করা হবে। এই দলিলের ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, কেন সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়ে গণভোট আয়োজন করা হচ্ছে না? উত্তরে ইউনূস বলেন, “গণভোট অনেকের কাছে অর্থহীন মনে হতে পারে। কারণ অনেকেই বোঝে না এর তাৎপর্য। তাছাড়া দলগুলো যদি একমত হয়, তাহলে গণভোট ছাড়াই সিদ্ধান্ত বাস্তবভিত্তিক হবে।”
আওয়ামী লীগের নির্বাচন থেকে বাদ পড়া, সামরিক বাহিনীর ভূমিকা, এবং নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন।” তিনি জানান, প্রায় ১৭ বছর পর জনগণ একটি প্রকৃত অর্থে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। নতুন ভোটারদের জন্য এটি একটি আবেগঘন ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত বলে তিনি মনে করেন।
“অনেক তরুণ-তরুণী প্রথমবারের মতো ভোট দেবে। এদের ভোটাধিকার ছিল, কিন্তু কখনো ব্যবহার করতে পারেনি। এবার তাদের সেই সুযোগ এসেছে। এটাই নতুন বাংলাদেশের সূচনা।”
তিনি বলেন, এই নির্বাচন কেবল রুটিন পরিবর্তনের নির্বাচন নয়, বরং এটি একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের রূপান্তরমূলক পদক্ষেপ। তিনি আরও বলেন, “যারা জীবন দিয়েছে গণতন্ত্রের জন্য, এই নির্বাচন তাদের স্বপ্নের প্রতিফলন।”
সংস্কারের জন্য তার সরকার ইতিমধ্যে কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে, যারা সংসদ, সংবিধান, নির্বাচন প্রক্রিয়া, এবং সরকারি সেবাসমূহের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তনের সুপারিশ দিচ্ছে। এই সুপারিশগুলো সব দলের সম্মতিতে গ্রহণযোগ্য করতে কাজ চলছে। ইউনূস বলেন, “এই কমিশনগুলোই ঠিক করবে কীভাবে সংস্কার হবে এবং কোন কোন প্রস্তাব দলগুলোর মধ্যে সমর্থন পাবে।”
তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, ইতিহাসে এমন কমিশনের কথা বাংলাদেশে আগে শোনা যায়নি যা সব দলের মতামত নিয়ে জাতীয় পুনর্গঠনের রূপরেখা তৈরি করে।
লন্ডনে সফররত ইউনূসের সঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারের সাক্ষাৎ এখনো নিশ্চিত হয়নি। তবে চ্যাথাম হাউজে দেওয়া বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তার নিজের ভবিষ্যৎ সরকারে অংশ নেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এই নতুন ধারা, নতুন প্রক্রিয়া, এবং সংস্কারচিন্তার আলোকে অধ্যাপক ইউনূস যে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এখন দেখার বিষয়—এই ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার যাত্রা কতটা সফল হয়।
আপনার মতামত জানানঃ