দেশে ইট পোড়ানো মৌসুম চলছে। অপরিকল্পিত এবং অবৈধ ইটভাটা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, লোকালয় ও বনাঞ্চলের আশপাশে, পাহাড়ের পাদদেশে এবং দুই বা তিন ফসলি কৃষি জমিতে ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এছাড়াও অনেক ইটভাটায় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়সহ জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন।
পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দেওয়া পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে যে, ঢাকা অঞ্চলের ২ হাজার ১৭টি ইটভাটার মধ্যে ৭৪৪টি ইটভাটা অবৈধ। আর সারা দেশের অর্ধেকই অবৈধ।
বুধবার (৯ মার্চ) দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শারিকা ইসলাম ও মাহবুবুল আলমের সমন্বয়ে একটি টিম পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযান চালায়। দুদকের জনসংযোগ দপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অবৈধভাবে ইটভাটা পরিচালনার অভিযোগের বিপরীতে অভিযানকালে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (মনিটরিং) ড. আবদুল হামিদ ও এনফোর্সমেন্ট উইংয়ের পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের বক্তব্য গ্রহণ করে টিম।
অভিযানে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে সারা দেশের মোট ইটভাটার প্রায় অর্ধেকই অবৈধ। শুধুমাত্র ঢাকা অঞ্চলে মোট ২০১৭টি ইটভাটার মধ্যে ৭৪৪টি ইটভাটা অবৈধ এবং খুলনা অঞ্চলের ৯৭৩টি ইটভাটার মধ্যে ৬২৪টি অবৈধ।
অভিযানের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি অবৈধ ইটভাটা বন্ধের পদক্ষেপ হিসেবে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযানসহ পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদান এবং লাইসেন্স নবায়নের বিষয়টি সঠিকভাবে পরিচালনায় জোর দেওয়া হচ্ছে বলে টিমকে জানানো হয়। তবে অভিযোগের তুলনায় অপর্যাপ্ত জনবলের কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে আবার হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার জন্য উচ্ছেদ অভিযানের গতি মন্থর হয়ে থাকে বলে জানায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট সেল।
দুদক টিম অবৈধ ঘোষিত ইটভাটা, সংশ্লিষ্ট হাইকোর্টের অর্ডার এবং পরিচালিত অভিযানগুলোর বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করে কমিশনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে বলে জানা গেছে।
বর্তমানে সারা দেশের মোট ইটভাটার প্রায় অর্ধেকই অবৈধ। শুধুমাত্র ঢাকা অঞ্চলে মোট ২০১৭টি ইটভাটার মধ্যে ৭৪৪টি ইটভাটা অবৈধ এবং খুলনা অঞ্চলের ৯৭৩টি ইটভাটার মধ্যে ৬২৪টি অবৈধ।
এদিকে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য মতে, দেশে মাত্র ৫৬ শতাংশ ইটভাটা বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আর বাকি ৪৪ শতাংশ ইটভাটা অবৈধ। এসব ইটভাটা বিগত বছরগুলোর মতো চলতি মৌসুমেও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিবেশগত ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে। ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়সহ জীব বৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে।
পবা জানায়, অনেক ইটভাটায় সরকার নির্ধারিত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে না। এর মধ্যে আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল-ক্লিনিক, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, লোকালয় ও বনাঞ্চলের আশপাশ, পাহাড়ের পাদদেশ এবং কৃষি জমিতে পরিচালিত হচ্ছে ইটভাটা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইটভাটার কারণে বায়ুদূষণের পাশাপাশি মাটি ও পানির ক্ষতি হয়। ইটভাটার আশপাশের এলাকার মানুষ চর্ম, ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে আক্রান্ত হন।
ভাটা মালিকদের সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি ড্রাম চিমনির ইটভাটায় প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৪০০ মণ জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। সে হিসাবে একটি ইটভাটায় প্রতি মাসে ১২ হাজার মণ জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ লাখ ইট তৈরিতে একেকটি চুল্লি থেকে প্রায় ৩৯৪ টন কার্বন, ১ হাজার ৪৪৪ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড, ৬ দশমিক ৩ টন মিথেন ও ১০২ টন নাইট্রিক অক্সাইড নিঃসৃত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য নানা অবকাঠামো নির্মাণে ইটের প্রয়োজন। কিন্তু দেশের প্রাণ-প্রকৃতিও রক্ষা করতে হবে। ইটভাটা হতে হবে পরিবেশবান্ধব। দেশের অবৈধ ইটভাটাগুলো উচ্ছেদ করতে দ্রুত অভিযান চালানো প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন সময় বেশ কিছু অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত বৈধভাবে আমদানি করা কয়লা অত্যন্ত নিম্নমানের ও উচ্চ সালফার যুক্ত। এই সালফার মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ইট পোড়াতে নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করায় সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক বায়ুদূষণ।
তারা বলেন, ইটভাটা সৃষ্ট দূষণ পরিবেশ বিপর্যয় ও জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে। দেশে গাছ লাগানো আজ একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমরা তার কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছি না। এর অন্যতম প্রধান কারণ ইটভাটায় নির্বিচারে কাঠ পোড়ানো।
আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার, নির্ধারিত মাত্রার সালফার যুক্ত কয়লা ব্যবহার, জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার থেকে বিরত থাকা এবং সংশ্লিষ্ট আইন যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে ইটভাটা সৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে জানান তারা।
তারা বলেন, এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ইটভাটা সংশ্লিষ্ট আইন বাস্তবায়নে ভাটার মালিকদেরও আসতে হবে এগিয়ে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৩৭
আপনার মতামত জানানঃ