দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা কে না জানে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এক পক্ষ ডানে গেলে আরেক পক্ষ যায় বামে। বহু ইস্যুতে দুই পক্ষকে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিতে দেখা গেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ইস্যুতে অনেকটা একই পথের পথিক ভারত ও পাকিস্তান। উভয় দেশই সরাসরি রুশ আগ্রাসনের প্রতিবাদ না জানিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শুধু শান্তি বজায় রাখার কথা বলেই ক্ষান্ত।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর মস্কোর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, আকাশপথ বন্ধ করে দেওয়াসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ। রাশিয়াকে নানাভাবে কোণঠাসা করতে তারা যখন ব্যস্ত, তখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ও পাকিস্তানের আচরণ কিছুটা ভিন্ন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। খবর আলজাজিরা
বিশ্লেষকদের ভাষ্য, ইউক্রেন নিয়ে চলমান উত্তেজনা কমানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই। তবে সহিংসতার দায় রাশিয়ার ওপর চাপানোর বিষয়টি সাবধানতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছে তারা।
একাধারে মস্কো ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাচ্ছে নয়াদিল্লি। তারা এমন কোনো মন্তব্য করছে না, যাতে করে ওয়াশিংটন ক্ষুব্ধ হয়। আবার তাদের তেমন কোনো বক্তব্য নেই রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। স্পষ্টতই ২০১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখলের ঘটনায় ভারতের ভূমিকা আর রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট চলাকালে আজকের ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান প্রায় অভিন্ন।
এখন পর্যন্ত ভারতীয় কূটনীতিকরা ইউক্রেন সংকট আবর্তন করে জনসমক্ষে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে রাশিয়া সন্তুষ্ট। জাতিসংঘে নয়াদিল্লির রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যে রাশিয়া গৃহীত সামরিক কৌশল নিয়ে সমালোচনা থেকে বিরত রয়েছেন। বিবদমান সব পক্ষের প্রতি তার উপদেশ হচ্ছে-সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন করুন। গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। চাপ দেননি; মোদি বলেছেন, সংলাপ করুন, যুদ্ধবিরতিতে যান।
গত রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি। এসময় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ইউক্রেন সংকট নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিবৃতির সঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের বক্তব্য ও ইউক্রেনীয় নেতাদের সঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথোপকথনের অনেকটাই মিল দেখতে পাওয়া যায়।
গত শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে মোদীর। এসময় এ সংকটের পেছনে কে দায়ী তা উল্লেখ না করেই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ওই ফোনালাপের বিষয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদী অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ ও সংলাপে ফিরতে ফের আহ্বান জানিয়েছেন এবং শান্তিপ্রতিষ্ঠায় যেকোনো উপায়ে অবদান রাখতে ভারতের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
এর দুদিন আগেই ইউক্রেনে পুরোদমে হামলা শুরু করে রাশিয়া। সে সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও একই সুরে কথা বলেছিলেন মোদী। ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সেনা প্রত্যাহারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আনা খসড়া প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকেও বিরত ছিল ভারত।
বিশ্লেষকরা বলেন, ভারতের এই কৌশল কতটা উপকারী, বোঝা ভার। কারণ ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ কয়েকটি বৃহৎ ভারতীয় স্বার্থক্ষয়ী।
প্রথমত, ইউক্রেনে পুতিনের অভিযান যত গভীর হবে, রাশিয়া ততই চীনের তলায় হারিয়ে যেতে থাকবে এবং সেক্ষেত্রে রাশিয়ার কাছে গুরুত্ব কমবে ভারতের।
দ্বিতীয়ত, ওয়াশিংটনকে যত বেশি ইউক্রেনের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনা শক্তির ভারসাম্য তত দীর্ঘায়িত হবে। এর কোনোটিই ভারতের জন্য ভালো নয়।
এদিকে চলমান সংকটের মধ্যে রাশিয়া সফরে যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। সেখানে গ্যাস পাইপলাইনের একটি প্রকল্প নিয়ে পুতিনের সঙ্গে আলোচনা হয় তার। পাশাপাশি আফগানিস্তানসহ আঞ্চলিক নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
পুতিন-ইমরান বৈঠকের পর একটি বিবৃতি প্রকাশ করে মস্কো। বিবৃতিতে ইউক্রেন সংকটের বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। পাকিস্তানও রুশ হামলার বিষয়টি সামনে আনতে বেশ সতর্কভাবে এগিয়েছে। ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতিকে শুধু ‘দুঃখজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছে দেশটি।
ইউক্রেন নিয়ে চলমান উত্তেজনা কমানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই। তবে সহিংসতার দায় রাশিয়ার ওপর চাপানোর বিষয়টি সাবধানতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছে তারা।
এ বিষয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়, ‘সংঘর্ষে কারও স্বার্থ নেই বলে জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর সংঘর্ষ বাধলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপরে সব সময় বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা আসে। সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে বিবাদের সমাধানে পাকিস্তান বিশ্বাসী।’
প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত ও পাকিস্তান—দুই দেশই কেন ইউক্রেন ইস্যুতে খোলাখুলিভাবে বাকচাতুরী করছে?
ভারত-রাশিয়ার পুরোনো বন্ধন
ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে সুসম্পর্ক কয়েক দশকের পুরোনো। বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশীয় দেশটিতে রুশ অস্ত্র রপ্তানিসহ অন্যান্য খাতে ব্যাপক সহযোগিতাই এর বড় কারণ। গত কয়েক বছরে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়েছে, যার প্রমাণ, মার্কিনিদের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সামরিক জোট কোয়াডের অন্যতম সদস্য নয়াদিল্লি।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে রাশিয়ার মোট অস্ত্র রপ্তানির আনুমানিক ২৩ শতাংশ গিয়েছিল ভারতে। একই সময়ে ভারতের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ছিল মোট অস্ত্র আমদানির অন্তত ৪৯ শতাংশ।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে পুতিনের নয়াদিল্লি সফরের পরপরই ভারত সরকার জানায়, তারা রাশিয়ার অত্যাধুনিক এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেতে শুরু করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে নিন্দা প্রস্তাবে ভারতের ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার কারণ সম্ভবত রুশ অস্ত্র আমদানি এবং যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন সম্পর্কিত দ্বন্দ্ব ইস্যুতে নয়াদিল্লির প্রায় একই ধরনের অবস্থান।
রাশিয়ার কাছে ঘেঁষার চেষ্টায় পাকিস্তান
স্নায়ুযুদ্ধের সময় পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করায় রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে বেশ অবনতি হয়। তবে গত কয়েক বছরে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।
তবে ইউক্রেন আক্রমণের দিনই রাশিয়া সফরে যাওয়ায় পাকিস্তানেই বিতর্কের মুখে পড়েছেন ইমরান খান। সেদিন পুতিনের সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা পাশাপাশি বসে কথা বলেছেন তিনি। প্রায় দুই দশকের মধ্যে প্রথম পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত সপ্তাহে মস্কো সফরে গিয়েছিলেন ইমরান খান।
দুই যুগের বেশি সময় পর চলতি মাসে পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া সফর করলেন। এর আগে অবশ্য দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ২০১১ সালে মস্কোতে তত্কালীন রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন–ইমরান বৈঠকের কেন্দ্রে থাকার কথা ছিল ‘পাকিস্তান স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের বিষয়টি। এ প্রকল্পের আওতায় দেশটির করাচি শহর থেকে পাঞ্জাব প্রদেশ পর্যন্ত ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, প্রকল্পটি চালু হলে পাকিস্তানে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি না বাড়লেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পাকিস্তানে গ্যাস সরবরাহ শুরু করতে পারবে। এতে করে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে রাশিয়ার ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠবে ইউরোপ।
ইউক্রেনে রুশ হামলায় পাকিস্তানের করার তেমন কিছু নেই বলে মন্তব্য করেন ইসলামাবাদভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিন্নাহ ইনস্টিটিউটের পরিচালক সালমান জাইদি। তিনি বলেন, ‘অর্থপূর্ণ কোনো দিক দিয়ে ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে পাকিস্তানের যেমন সংশ্লিষ্টতা নেই, তেমন দক্ষিণ এশিয়ারও নেই। এ অঞ্চলের নেতাদের বিবৃতিতে এমনটিই দেখা যায়।’
এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোয় রাশিয়ার বাণিজ্য উপস্থিতি তেমন বৃহৎ নয়। নেপাল ও বাংলাদেশের শক্তি খাতে রাশিয়ার কিছু বিনিয়োগ আছে; আর আছে শ্রীলংকার চা উৎপাদনে। তবে মজার বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে ইউক্রেন সংকট। নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হলে অবশ্যই নতুন বাজার খোঁজায় ঝুঁকবে রাশিয়া। সেক্ষেত্রে যেহেতু এ অঞ্চলে চীনের বর্ধিত বিনিয়োগ রয়েছে, সেহেতু চীনা বিনিয়োগের ছদ্মাবরণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাজার বৃদ্ধির চেষ্টা চালাতে পারেন পুতিন। সেক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির নীতিনির্ধারকরা বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন— তারা কি পুরোনো পশ্চিমা বাজারেই আবদ্ধ থাকবেন, নাকি ছুটবেন রুশ বিনিয়োগের পেছনে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ