টাঙ্গাইলে ভাঙন থামছে না যমুনা নদীতে। শতাধিক বাড়িঘরসহ মসজিদ, হাট-বাজার, তাঁত কারখানা, স’মিল, আবাদি জমি ও রাস্তাঘাট এর মধ্যেই যমুনার গর্ভে চলে গেছে। ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফেলা জিও ব্যাগও কাজে আসছে না। ফলে চরম আতঙ্কে দিন পার করছেন যমুনা তীরবর্তী বাসিন্দারা।
যমুনা নদীর কোলঘেঁষা টাঙ্গাইল সদর উপজেলা, কালিহাতী, নাগরপুর ও ভূঞাপুর উপজেলায় ভাঙন শুরু হয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্প্রতি ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে।
গতবছরে ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি সরিয়ে এনে এখনো ঠিকভাবে দাঁড় করাতে পারেনি, আবারও ভাঙ্গনে সরিয়ে নিতে হচ্ছে। রাক্ষুসি যমুনা চোখের সামনে সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে।
সদর উপজেলার চরপৌলী, মাকরকোল, কেশবমাইঝাইল, তিতুলিয়া, নয়াপাড়া, কুকুরিয়া, বারবাড়িয়া, দেওরগাছা, রশিদপুর, ইছাপাশা, খোশালিয়া, চানপাশা, নন্দপাশা, মসপুর, কালিহাতী উপজেলার আলীপুর, ভৈরববাড়ী, ভূঞাপুর উপজেলার ভালকুটিয়া, নাগরপুর উপজেলার পাইকশা মাইঝাইল, খাষঘুণি পাড়া, খাষতেবাড়িয়া ও চর সলিমাবাদ এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা বেশি।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বর্ষণে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্লাবিত হচ্ছে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা। এ মাসের শুরুর দিকে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে কাজিপুর, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায় দেখা দেয় তীব্র নদী ভাঙ্গন।
চৌহালীর বিনাইন গ্রামের শফিকুল ইসলাম বলেন, ভাঙনের কারণে আমরা ঘরবাড়ি সরানোর কাজে ব্যাস্ত। গতবছরে ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি সরিয়ে এনে এখনো ঠিকভাবে দাঁড় করাতে পারেনি, আবারও ভাঙ্গনে সরিয়ে নিতে হচ্ছে। রাক্ষুসি যমুনা চোখের সামনে সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে।
একই গ্রামের শাহাবুদ্দিন বলেন, বসতবাড়ি, বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কমিউনিটি ক্লিনিক ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে। তবুও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেখা পাচ্ছি না। বাঁধ নির্মাণের কথা থাকলেও তা হচ্ছে না।
চৌহালী উপজেলার ভাঙনরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিনাইন এলাকায় ভাঙন রোধে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে। চৌহালী দক্ষিণ এলাকা রক্ষায় ৪৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এটি নির্মাণ করা গেলে এই এলাকায় আর ভাঙ্গন থাকবে না।
এদিকে সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলী গ্রামেও এক সপ্তাহে দেড় শতাধিক ভিটেবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া যমুনার পেটে চলে গেছে মসজিদ, হাটখোলা, তাঁত কারখানা ও স’মিল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড হাটখোলাটি রক্ষার জন্য জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে ৩০০ মিটার এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলেছিল। পরে ব্যাগগুলোও যমুনার তীব্র স্রোতে তলিয়ে গেছে।
চরপৌলী গ্রামের বাসিন্দা তাঁত শ্রমিক মিজানুর রহমান বলেন, এক দিনেই আমার ভিটেবাড়িসহ দুইটি ঘর গিলে খেয়েছে। এক সপ্তাহের ভাঙনে আমার ২৪ শতাংশ জমির মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ চলে গেছে নদীতে। এখন আমার থাকার জায়গাটুকুও নেই। পরিবার নিয়ে চরম দুর্ভোগে রয়েছি।
এক সপ্তাহে এই ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি ভিটেবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। থাকার জায়গা না পেয়ে গাছতলায় আশ্রয় নিচ্ছে অনেকে। ভিটেবাড়ি হারিয়ে তারা চরম দুর্ভোগে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেললেও কাজ হচ্ছে না।
চরপৌলী ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আল আমিন মোল্লাহ বলেন, এক সপ্তাহের ভাঙনে শতাধিক ভিটেবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতি বছরই অসংখ্য ভিটেবাড়ি এভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু কিছু জায়গায় জিও ব্যাগ ফেলছে। তবে জিও ব্যাগ না ফেলে শুকনো মৌসুমে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তা না নিলে ধীরে ধীরে এ ইউনিয়নের অস্তিত্ব থাকবে না।
চরপৌলী ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুর রহিম বাদশা বলেন, এক সপ্তাহে এই ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি ভিটেবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। থাকার জায়গা না পেয়ে গাছতলায় আশ্রয় নিচ্ছে অনেকে। ভিটেবাড়ি হারিয়ে তারা চরম দুর্ভোগে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেললেও কাজ হচ্ছে না।
প্রায় ৩০ বছরের ভাঙনে একাধিক গ্রাম একেবারেই বিলীন হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে স্থানীয় বাঁধ দেওয়া প্রয়োজন। এভাবে ভাঙতে থাকলে এ ইউনিয়নও হারিয়ে যাবে।
সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, কয়েক বছরের ভাঙনে একাধিক গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহের ভাঙনে যমুনা নদীর পেটে চলে গেছে এ ইউনিয়নের দুই শতাধিক ভিটেবাড়ি।
যমুনা নদীর তীরবর্তী এলাকা প্রতিবছরই ভাঙনের শিকার হয়। ভাঙনরোধে তিন বছর আগে একটি স্থায়ী বাঁধের প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হয়নি। জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এছাড়া হাট-বাজার ও মসজিদ ছাড়াও বহু স্থাপনা নদীর পেটে চলে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলছে কিন্তু তাতে কোনও কাজ হচ্ছে না।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, যমুনা নদীর তীরবর্তী এলাকা প্রতিবছরই ভাঙনের শিকার হয়। ভাঙনরোধে তিন বছর আগে একটি স্থায়ী বাঁধের প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হয়নি। জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এর আগেও গত মাসের শুরুতেই সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে হঠাৎই যমুনা নদীতে তীব্র ভাঙন শুরু হয়। গত পাঁচ দিনে উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রামের শতাধিক ঘরবাড়ি, ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। হুমকির মুখে পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ধর্মীয় উপাসনালয়। ভাঙন রোধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় এসব এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে সে সময় ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ এর কাছাকাছি ভারতের আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের কারণে যমুনা নদীতে পানি বাড়ছে। এ কারণেই ভাঙন দেখা দিয়েছে।
এদিকে, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে বন্যার প্রকোপ তেমন না থাকলেও যমুনার কিছু স্থানে ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে করে নদীপাড়ের মানুষদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, খুব সীমিত আকারে নদী ভাঙন দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে ভাঙন আতঙ্কে স্থানীয়দের অনেকেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, যমুনা নদীতে পানি অনেক কমে যাওয়ায় রোববার (১৮ জুলাই) সকাল ৮টায় পানির প্রবাহ ১৫ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটারে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে এখনো বিপদসীমার প্রায় ৩ ফুট নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
যদিও পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে যমুনা নদীর ডান তীরের বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ সারিয়াকান্দি এলাকার কামালপুর ইউনিয়নের যমুনা নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন গ্রামে ভাঙনের খবর পাওয়া গেছে।
ওইসব গ্রাম এলাকার পুরাতন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ থেকে বসবাসরত ২৫টি পরিবার ঘর-দোর অন্যত্র সরে নিয়ে গেছেন। এসব পরিবার পার্শ্ববর্তী হাওয়াখালী গ্রামের নতুন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের উপর আশ্রয় নিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ