ফেসবুকের মাধ্যমে দুই কিশোরীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সূত্র মতে, দুই বছর ধরে চলে এই প্রেম। প্রেমের টানে দূরপথ পেরিয়ে আবারো একত্র হয়েছে এই দুই কিশোরী। গত সোমবার (২১ মার্চ) টাঙ্গাইলে নিজ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানান, তাদের মধ্যে প্রায় দুই বছর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হয়। সেই থেকেই ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। প্রেমের টানে তারা প্রায় দুই মাস আগে ঢাকার সাভারে এক আত্মীয়ের বাসায় রাত্রীযাপন করে।
এরপর সেখান থেকে আনোয়ার নামের এক ব্যক্তির সাথে তারা সিরাজগঞ্জের চৌহালী গিয়ে রাত কাটায়। সেখানে স্থানীয়দের এই দুই কিশোরীর আচরণ সন্দেহজনক হলে বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হয়।
একপর্যায়ে স্থানীয়দের উপস্থিতিতে দুই পরিবারের কাছে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। সর্বশেষ রবিবার (২০ মার্চ) তাদের ফোনে কথা হয়। এরপর সন্ধ্যায় নোয়াখালীর কিশোরী টাঙ্গাইল শহরে আসলে অপর কিশোরী স্কুল থেকে সেখানে গিয়ে তার বাড়িতে নিয়ে যায়।
ওই রাতেই তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তাদের দেখতে দলে দলে লোকজন গিয়ে ওই বাড়িতে ভিড় জমায়। এই দুই কিশোরী সংসার করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে বলে জানা যায়।
এ ঘটনায় টাঙ্গাইলের কিশোরীর বাবা বলেন, মেয়েটা আমার আদরের একমাত্র সন্তান। তার এমন কাণ্ডে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। নোয়াখালীর ওই মেয়েটিকে তার বাড়িতে চলে যেতে বলছি- সে যাচ্ছে না। সে কিছুতেই তাকে ছাড়া যাবে না। পরে তার পরিবারকে বিষয়টি জানানো হলে তারা এখানে আসবে না বলে আমাকে জানায়। প্রশাসনকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। আমি বিষয়টি নিয়ে খুবই বিপদে আছি।’
এলাকার ইউপি সদস্য বলেন, নোয়াখালীর ওই মেয়েটি রবিবার সন্ধ্যায় এসেছে। বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। দুই কিশোরীর দাবি- তারা কেউ কাউকে ছাড়া থাকবে না। তারা গার্মেন্টসে চাকরি করে একত্রে সারাজীবন কাটাবে বলে জানায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেব বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে নোয়াখালীতে প্রশাসনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। মেয়েটির প্রকৃত অভিভাবকের খুঁজ পেলে তাদের হাতে মেয়েটিকে ফিরিয়ে দেব। আর তার পরিবার খুঁজে না পেলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’
থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বলেন, ‘ঘটনাটি শুনেছি। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্যের সাথে কথা হয়েছে। নোয়াখালীর ওই মেয়েটির পরিবারকে তারা বিষয়টি জানিয়েছে। মেয়েটির পরিবার আসলে তাকে ফিরিয়ে দিতে বলেছি।’
পরিচয় ফাঁস ও নিরাপত্তার শঙ্কা
ফেসবুকে পরিচয় হওয়ার পর এক কিশোরীর সাথে একসঙ্গে থাকবার জন্য নোয়াখালি থেকে টাঙ্গাইলে এক কিশোরীর ছুটে যাওয়ার খবর নিয়ে বাংলাদেশে তোলপাড় চলছে।
ওই দুই কিশোরী এখন নিজ নিজ পরিবারের জিম্মায় থাকলেও তাদের সমকামি ইঙ্গিত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ ও তাদের সবিস্তার পরিচয় ব্যাপকভাবে প্রচার হওয়ায় তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই কিশোরীকে নিয়ে অনেকের নেতিবাচক মন্তব্যের কারণেই এমন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সাংবাদিক ও গবেষক আফসান চৌধুরী বলছেন গণমাধ্যম এ সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে দুই কিশোরীর নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা, কোনটিকেই বিবেচনায় নেয়নি, যা তাদের সমাজে অনিরাপদ করে তুলতে পারে।
তিনি বলেন, যেভাবে নাম পরিচয় প্রকাশ করে সংবাদগুলো প্রকাশ করা হয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। এদেশে ভিন্নমতের বা ভিন্ন চিন্তার মানুষদের খুন করার উদাহরণ আছে। দুই কিশোরীর মধ্যে যে সম্পর্কই থাক যেভাবে খবর এসেছে সেকারণে এদের কোন ক্ষতি হলে তার দায় কে নেবে।
তবে টাঙ্গাইলের ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলছেন, তার এলাকার মেয়েটির নিরাপত্তার দায়িত্ব তিনিই নিয়েছেন। অন্যদিকে নোয়াখালীর মেয়েটির খোঁজখবর নেবে সেখানকার প্রশাসন।
তিনি বলেন, নিরাপত্তাজনিত সমস্যা হতে পারে এমন কোন কিছু আমি তাদের মধ্যে দেখিনি। যেভাবে প্রচার করা হয়েছে সেটি ঠিক হয়নি, কারণ বিষয়টি তেমন নয় বলেই মনে হচ্ছে।
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই কিশোরীর নাম পরিচয় প্রকাশের সুযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা হওয়ায় তাদের দুজনের নিরাপত্তার সমস্যা হতে পারে কি-না গণমাধ্যমের এমন প্রশ্নের জবাবে বাসাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা পারভীন বলেন, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অন্য সবার মতো তারা যথাযথ সুরক্ষা পাবে। কেউই বেআইনি কিছু করতে পারবে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন সেটি দেখবে।
গবেষক আফসান চৌধুরী অবশ্য উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন যে কোনভাবেই তাদের ও তাদের পরিবারের নাম পরিচয় প্রকাশ করা উচিৎ হয়নি।
তিনি বলেন, এদেশে রাজনীতিক, সম্পাদক আর গণমাধ্যম কর্মীর স্বাধীনতাকেই স্বাধীনতা বলা হয়। সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা গণমাধ্যমের কাছেও বিবেচ্য হয় না। এই দুটি বাচ্চা মেয়েরও যে স্বাধীনতার অধিকার আছে সেটিকে বিবেচনা করা হয়নি। এখন তারা যদি কোন সমস্যায় পড়ে তাহলে দায়টা কার হবে?
বাংলাদেশের আইন কী বলছে?
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা মোতাবেক সমকামিতা শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ৷ এজন্য দশ বছর থেকে আজীবন কারাদণ্ড, সাথে জরিমানার বিধান রয়েছে৷ ১৮৯৮ সালের আইন এটি, যার একই ধারা চালু ছিল ভারতেও৷ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সেটি বাতিল করে সমকামীতা কোন অপরাধ নয় বলে রায় দিয়েছে৷
শাহানূর ইসলামের মতে, এই ধারাটি বাংলাদেশের সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক৷ তার প্রশ্ন, প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে ও মেয়ে কারো অগোচরে যৌন সম্পর্ক করলে তা অপরাধ না৷ তাহলে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে বা মেয়ে কারো অগোচরে যদি সেক্সচুয়াল ইন্টারকোর্স করে, তাহলে কেন সেটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷ সংবিধানের ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান৷ কিন্তু এখানে ঠিকই বৈষম্য হচ্ছে৷
দেশে এই আইন বাতিলের সহসাই কোনো সম্ভাবনা অবশ্য তিনি দেখেন না৷ তার মতে, রাজনৈতিক কারণে সরকার এই উদ্যোগ নেবে না৷ একমাত্র আদালতে রিটের মাধ্যমেই ধারাটি বাতিল করা যেতে পারে৷ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কারো পক্ষে এই উদ্যোগ নেয়া সম্ভব নয়৷
তবে সমকামীদের মতে, তাদের প্রতি সমাজের মনোভাব পরিবর্তনটাই বেশি জরুরি৷ অপরাধী কিংবা সমকামী হওয়ার জন্য নিজেরা দায়ী নন বলে মনে করেন তারা৷
সমকামীদের একজন বলেন, মেরে ফেলার ভয় দেখানো থেকে শুরু করে আইনের ভয়, সামাজিক চাপ, সবকিছুর পরও যখন আমরা পরিবর্তিত হতে পারছি না, তখন এটা ধরেই নিতে হবে যে, আমরা জন্মগতভাবে এমন৷
এইডব্লিউ/এসএস/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ