বগুড়া শহরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজের অবস্থান জানান দিতে তিন খুন, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির ওরফে বাউল সেলিম ওরফে খুনী হেলাল (৪৫)। এ ঘটনার পর খুনী হেলাল ওরফে দুর্ধর্ষ হেলাল নামে এলাকায় পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।
পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে বাউল বেশ ধারণ করে সেলিম ফকির নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ভৈরব স্টেশনে গান গেয়ে নতুন করে জীবন শুরু করেন। পরে দ্বিতীয় বিয়ে করে দুর্ধর্ষ খুনী এই বাউল হেলাল।
মূলত হত্যাকাণ্ডের সাজা থেকে বাঁচতেই তার এসব কৌশল। এভাবে ২০ বছর ধরে বাউল ছদ্মবেশে ঘুরেছেন তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। অবশেষে র্যাবের জালে ধরা পড়েন। বুধবার রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে হেলাল হোসেন ওরফে খুনী হেলাল ওরফে সেলিম ফকিরকে গ্রেফতার করে র্যাব।
যেভাবে ধরা পড়লেন
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
র্যাবের মুখপাত্র জানান, হেলালের কপাল পোড়ে- ‘ভাঙ্গা তরী ছেঁড়া পাল’ গানে বাউল মডেল হিসেবে অভিনয়ের পর। প্রায় পাঁচ বছর আগে মডেলিং করা তার এই গানটি বছরখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তার গান ভাইরাল হওয়াই কাল হয় হেলালের।
পরিচিতজনরা তাকে চিনে ফেলেন। পরে স্থানীয়দের তথ্য ধরে ছয় মাস চেষ্টার পর র্যাবের গোয়েন্দারা তার অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হন। পরে হেলাল হোসেন ওরফে খুনি হেলালকে গ্রেফতার করা হয়।
হেলাল হোসেনের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলায় তার সাজাও দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া আরও দুটি ফৌজদারি অপরাধের মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
খন্দকার আল মঈন জানান, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা শেষে বগুড়া শহরে মুদি দোকান চালাত হেলাল। পরে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। গ্রেফতার এড়াতে ছদ্মবেশে বিভিন্ন মাজার ও রেলওয়ে স্টেশনে থাকা শুরু করেন। কেউ যাতে তার চেহারা চিনতে না পারেন, সে জন্য লম্বা দাড়ি ও চুল রাখেন।
২০১৭ সালের দিকে হেলাল নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে কিশোর পলাশ ওরফে গামছা পলাশের একটি গানের শূটিং চলাকালে রেললাইনের পাশে বাউল গান গাচ্ছিলেন।
তখন এক ব্যক্তি তাকে গানের মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। এরপর বহুল জনপ্রিয় ‘ভাঙ্গা তরী ছেঁড়া পাল’ গানে মডেলিং হন হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির।
বগুড়ার বিদ্যুত হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডের পর হেলাল বগুড়া থেকে পালিয়ে যান। প্রায় সাত বছর ফেরারি জীবনযাপন করেছেন। সর্বশেষ চার বছর তিনি কাটিয়ছেন কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনে। সেখানে স্টেশনের পাশেই এক নারীকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। স্টেশনে বাউল গান শুনিয়ে মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অর্থেই চলত তার সংসার।
প্রায় ৫ বছর আগে কিশোর পলাশ ওরফে গামছা পলাশ একটি গানের শূটিং করছিলেন নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে। শূটিং চলার সময় রেললাইনের পাশ দিয়ে একজন বাউল যাচ্ছিলেন। তখন শূটিংয়ের পরিচালক তাকে গানের মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। হেলাল মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল শিরোনামে গানের মডেল হিসেবে পরে তাকে দেখা যায়। ইউটিউবে গানটির ভিডিওচিত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বিপুল সংখ্যক দর্শক এই গানটি ইউটিউবে দেখেন। ৪৬ মিলিয়ন ভিউ হয় গানটির। এই গানটি যখন প্রচার হয়, এটি বগুড়ার বিভিন্ন লোকজন দেখে।
পরে এলাকাবাসী জানান, বগুড়ায় বেশ কয়েকটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বাউলবেশী হেলাল। বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ছয় মাসের চেষ্টায় তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন বলে জানান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। হত্যা মামলা থেকে নিজেকে আড়াল করতেই ছদ্মবেশ ধরেন হেলাল।
খন্দকার আল মঈন জানান, ছয় মাস আগে এক ব্যক্তি ইউটিউবে প্রচারিত একটি গানের বাউল মডেল সম্পর্কে র্যাবের কাছে তথ্য দেন। তখন জানানো হয়, এই বাউল মডেল সম্ভবত বগুড়ার বিদ্যুত হত্যা মামলার আসামি। অভিযোগ পেয়ে র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। একপর্যায়ে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয় র্যাব।
যত অপরাধ বাউল হেলালের
প্রায় দুই যুগ আগে খুন, সন্ত্রাস, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে নিজ এলাকায় ‘দুর্ধর্ষ হেলাল ওরফে খুনি হেলাল’ নামে পরিচিতি ছিল। তার বিরুদ্ধে যে ৩টি হত্যা মামলা রয়েছে, সবগুলোই বগুড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে।
তিনি বগুড়ার একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে বগুড়ার বিষ্ণু হত্যা মামলা, ২০০১ সালে বগুড়ার চাঞ্চল্যকর বিদ্যুত হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি তিনি। ২০০৬ সালে রবিউল হত্যা মামলার আসামি ছাড়াও ২০১০ সালে বগুড়া সদর থানায় দায়ের করা একটি চুরির মামলায় ২০১৫ সালে তিনি গ্রেফতার হন।
২০১১ সালে তার বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ২০০০ সালে বগুড়া শহরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে বামহাতে আঘাত পান তিনি এবং একপর্যায়ে তার বাম হাত পঙ্গু হয়ে যায়।
এ ঘটনার পর থেকে এলাকায় এসে হাত লুলা হেলাল নামেও পরিচিতি ছিল তার। গ্রেফতারকৃত হেলালকে সিরিয়াল কিলার হিসেবে ব্যাখ্যা দেয়ার কারণ সম্পর্কে র্যাব জানায়, তার বক্তব্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত তিনটি হত্যা মামলায় তিনি জড়িত।
২০০৯ সালের পর ঘটা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য আমরা সহজেই পেয়ে যাই। কিন্তু এর আগের তথ্য থানা থেকে সংগ্রহ করতে হয়। আমরা যখন তাকে থানা পুলিশে হস্তান্তর করব, তখন থানা পুলিশও এসব বিষয় খতিয়ে দেখবে। পরে তারাও আরও কোন মামলার সংশ্লিষ্টতা পেতে পারে।
যেভাবে বাউলবেশে ছদ্মবেশ
অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে মুদিখানার দোকান চালাতেন হেলাল। ২০১০ সালে চুরির মামলায় গ্রেফতার হন। এরপর ২০১৫ সালে জামিন পান। ওই দিনই বিদ্যুত হত্যা মামলার রায় হয়। রায়ে আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। আদালতে হাজির না হয়ে তিনি সুকৌশলে এলাকা ছাড়েন। এরপর শুরু হেলালের ফেরারি জীবন।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত হেলাল জানান, প্রথমে তিনি বগুড়া থেকে ট্রেনে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আসেন। পরে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম যান। সেখানে আমানত শাহের মাজারে ছদ্মবেশ ধারণ করে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন।
পরে ট্রেনে সিলেটের হযরত শাহজালাল মাজারে চলে যান। সেখানে ছদ্মবেশ ধারণ করে আরও কিছুদিন অবস্থান করেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন রেলস্টেশন ও মাজারে ছদ্মবেশে অবস্থান করেন। কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনে গিয়ে নাম-ঠিকানা ও পরিচয় গোপন করেন হেলাল। নিজেকে সেলিম ফকির নামে পরিচয় দেন। সেখান থেকে তিনি সেলিম ফকির নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ