আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষ নদী অববাহিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে এ তথ্য সবার জানা। তাদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা এবং চরের উন্নয়নের জন্য সরকারকে আরো বেশি নজর দিতে হবে। তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে। চরবাসিদের কাজে লাগাতে হবে। চরের মানুষ অনেক পরিশ্রমী, তাদের শ্রমকে সম্পদে পরিণত করা শুধু উদ্যোগের ব্যাপার।
যদিও বেসরকারি কিছু এনজিও চরের মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলে দু-একটি প্রল্পের কার্যক্রম চালিয়েছে। তবে এসব প্রল্পের বেশির ভাগই লোক দেখানো মাত্র। নদীপাড়ের মানুষদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন না হলেও ভাগ্যের পরির্বতন হয়েছে এনজিওগুলোর।
চরের মানুষের স্বাস্থবেসা নিশ্চিৎ করার জন্য স্থায়ী চিকিৎসালয় স্থাপন করা সময়ের দাবি। বিশেষ করে একজন সন্তানসম্ভাবা নারীদের যখন প্রসব ব্যথা ওঠে কখন তাদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেয়ার কিছুই থাকে না এই সব এলাকায়। এছাড়াও শিশু বৃদ্ধদের বেলাতেও একই অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। মধ্যযুগীয় পদ্ধতি কাঠের চকিতে রোগীকে শুয়ে তাতে বাঁশ লাগিয়ে ঘাড়ে করে বহন করে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে আনতে হয়।
এছাড়া শিক্ষা উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় চরের শত শত শিশু প্রথমিক শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। হাতে গোণা কিছু চরে প্রাথমিক শিক্ষার স্বল্প পরিসরে থাকলেও বেশির ভাগ চরেই নেই। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় চরের শিশু কিশোররা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে শ্রমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। মেয়েদের কিশোরীকালেই বিবাহ দিয়ে দিচ্ছেন পরিবারের পক্ষ থেকে। এই আধুনিক বাংলাদেশে এই অঞ্চলগুলোয় এখনো বাল্যবিবাহ প্রতিনিয়তই হচ্ছে। তাদের সেই ভাবে সচেতনা সৃষ্টির জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না।
স্বাধীনতার ৫০ বছরেও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটেনি চরবাসীর। ফলে স্বাস্থ্য চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত রয়েছেন চরাঞ্চলের মানুষ। উত্তরের জেলা নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার তিস্তার তীরবর্তী বুড়িতিস্তা নদীবাহিত চার ইউনিয়ন— গোলমণ্ডা, ডাউয়াবাড়ী শৌলমারী ও কৈমারীর চরে বসবাসকারী পরিবারগুলোর যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নদীপথ আর বর্ষাকালের বাহন নৌকা।
ফলে চর এলাকায় তেমন কোনো রাস্তাঘাট না থাকায় অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের।
এ অঞ্চলটির ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদনদীর বুকে জেগে ওঠা বালুচরে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় ভূমিহীন কৃষকরা কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন।
একসময় এসব নদী ছিল তাদের দুঃখের কারণ, এখন সেই নদীর চরে বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে অভাব দূর করছেন তারা। অক্লান্ত পরিশ্রমে অসম্ভবকে সম্ভব করে বাঁচার স্বপ্নপূরণে ফলাচ্ছে নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া পরিবারগুলো।
নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের পলিযুক্ত বেলে দোআঁশ মাটিতে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের স্বপ্নের ফসল বুনে ঘরে তুলে লাভবান হচ্ছেন চরের এসব নিঃস্ব খেটে খাওয়া মানুষ। তিস্তার ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে অনেক পরিবার।
চর এলাকায় আমিনুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ৮-৯ বছর আগে নদীভাঙনে জমিজায়গা হারিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়ে ছিলাম। সংসারে খুব অভাব-অনটন ছিল, কাজকর্মও ছিল না। বাধ্য হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে জেগে ওঠা চরে ভুট্টা, আলু ও সবজি চাষ করে এখন আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।
চরাঞ্চলের এই মানুষগুলোর স্বাস্থ্যসেবার জন্য নেই কোনো মানসম্মত কমিনিউটি ক্লিনিক। অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় স্বজনদের কাঁধে করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে যেতে হয়।
তাদের দাবি, বর্তমান সরকার আমলে সারা দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও রাস্তাঘাটের দিক থেকে আমরা বঞ্চিত রয়েছি। ভালো যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় উপজেলা সদর যাতায়াতে খুবকষ্ট হয়। চরে কমিউনিটি ক্লিনিক না থাকায় সময়মতো চিকিৎসা করাতে পারেন না।
বন্যায় যাতায়াতে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। এ সময় কেউ অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসাসেবা পাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে অনেক রোগী চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। বুড়িতিস্তা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ এবং রাস্তাঘাট হলে তারা এ দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেতেন। তিস্তার চরে গুরুত্বপূর্ণ ঘাট গুলোতে সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন চরবাসি।
কৈমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাদেকুল সিদ্দিক সাদেক বলেন, চর এলাকার মানুষের চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে সব ইউপি সদস্যকে নিয়ে রেজুলেশন করেছি। শিগগিরই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এএইচএম রেজওয়ানুল কবির বলেন, শৌলমারী ইউনিয়নের চরবাসীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য ইতোমধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক একটি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার যমুনা নদীর চর এলাকার সাতটি ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষের জরুরি চিকিৎসা সেবায় এ রকম দুর্ভোগ কষ্ট পোহাতে হয় প্রতিদিন। বিশেষ করে শিমুলতাইড়, কাকালিহাতা, হাটবাড়ী, নয়াপাড়া, চকরতিনাথ, টেকামাগুড়া, চরদলিকা, বেনীপুর, কাজলা, ময়ুরেরচর, নান্দীনারচর, ধরাবর্ষারচর, মাজিরাচরসহ প্রায় ৮০টি চরের মানুষ জরুরী চিকিৎসা সেবা না পেয়ে অবর্ননীয় কষ্টে আছেন। চর গুলোতে মা ও শিশু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে হরহামেশায়।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের বাটিরচর গ্রামের বৃদ্ধ বাবুশাহ (৯০)। বৃদ্ধ বাবুর ৫ ছেলে, ২ মেয়ে। নদী ভাঙনের কারণে বসত বাড়ি হারিয়ে বর্তমানে চরের জমি চাষাবাদ করে সংসার চলে তার। শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধলেও পেটের প্রচণ্ড ব্যথায় ছটফট করেন মাঝে মধ্যেই। একবার অসহ্য পেট ব্যথা শুরু হলে ছোট আকারের চৌকিতে করে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে হাসপাতালে। এ নিয়ে তার বড় ছেলে শাহ আলম বলেন, বাবার পেটের ব্যথা যখন শুরু হয়, তখন চিৎকার করে হা-হুতাশ করতে থাকেন। যখন রাতের বেলা ব্যথা শুরু হয় তখন চরে করার কিছুই থাকে না আমাদের।
বাড়ি থেকে সারিয়াকান্দি হাসপাতালে আসতে প্রায় ৪ কি.মি পথ পাড়ি দিতে হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩ কি.মি. বালুময় পথ পাড়ি দিয়ে খেয়া পারের জন্য ঘাটে পৌঁছুতে হয়। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর খেয়া পার হয়ে আবার আধা ঘণ্টা সাই করে রুগীকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হয়। সব মিলিয়ে আধা ঘণ্টার পথ, দীর্ঘ ২ আড়াই ঘণ্টাতেও যেন চরের পথ শেষ হতে চায় না। এ রকম সমস্যা শুধু আমাদের একার নয়।
যমুনা ব্রিজের পশ্চিম পাশ থেকে শুরু করে উত্তর প্রান্ত কুড়িগ্রাম পর্যন্ত যমুনার অববাহিকায় দেড় হাজারের বেশি চর জেগেছে। এসব চরের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক চরে মানুষ বসবাস করে। শিক্ষার আলো, স্বাস্থ্যসেবা, সড়ক সেবাসহ প্রায় সব ধরনের নাগরিক সেবা বঞ্চিত বরাবরই এই মানুষগুলো।
বালির মাঝেই চাষাবাদ এবং গরু ছাগল পালন এদের প্রধান পেশা। এখন অবশ্য অনেক চরে মরিচ, আলু, বাদাম, গোম, ভুট্টাসহ প্রায় সব রকমের ফসলের চাষ হয়। তার পরেও এই চারের কৃষিকরা বঞ্চিত কৃষি সেবা থেকেও। কিছু না পেলেও এই মানুষগুলোর না পাওয়ার কোনো অভিযোগ নেই।
যমুনা পাড়েও অসংখ্য চর আছে। এসব চরের মানুষরা আধুনিক বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে এখনো অবস্থান করছে। অনেক এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। বিদ্যুত তাদের কল্পনার বিষয়। সমসাময়িক প্রেক্ষাপট, দ্বীন-দুনিয়ার অনেক তথ্য থেকে তারা এখনো অনেক ব্যবধানে আছে।
বেশির ভাগ চরে বালির মাটি হওয়ার কারণে রাস্তা বাধার কোন পরিস্থিতি নেই। তবে যেসব চর দীর্ঘদিন আগে জেগেছে সে সব চরে এখন দোঁ-আশ, এঁটেল মাটির স্তর তৈরি হয়েছে। এসব এটেল, দোঁ-আশ মাটির চরগুলোতেও রাস্তা ঘাট চোখে পড়ে না। দশ-বিশ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটেই তাদের বাজারে কেনাবেচা করতে হয়।
বিশেষ করে এসব চরাঞ্চলের কৃষিপণ্য বিক্রির সময় চাষিদের বিপাকে পড়তে হয়। ঘাড়ে-পিঠে বহন করেই বাজার পর্যন্ত আনতে হয় তাদের। তবে বর্ষা মৌসুমে প্রতিটি বাড়ির কিনারায় পানি ওঠায় নৌকায় এসব পণ্য বহন করতে সুবিধা হয়। এই সুবিধা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। মাস দুয়েক পরে আবারো আগের হালে চলে চরের মানুষ।
বাংলাদেশ সামনের দিকে এগুলোও দিন দিন পেছনের পথে হাঁটছে চরের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষ। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনে কেউ না আসলেও নিজেরাই সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু চরে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে স্বপ্ল পরিসরে। বিস্তর পরিসরের ডিশ না থাকলেও স্থানীয়ভাবে ছোট ছোট ডিশ এন্টেনার সংযোগে চলছে টেলিভিশন।
তাদের প্রচেষ্টার পাশাপাশি সরকার ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান পাশে দাঁড়ালে চরবাসীর জীবন যাত্রার মান কিছুটা হলেও বড়বে বলে মনে করছেন তারা। এদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ছাড়া এই মানুষগুলোর কোনো কাজে পাশে আসে না। প্রতি পাঁচ বছর পরপর তাদের সাময়িক পদচারণা দেখা গেলেও ভোট শেষে চরের বালুতে আর কখনো পা রাখেন না তারা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ