বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি উদ্যোগের সাফল্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সর্বদা বলেছি, একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ রাজনীতির দরকার। সেটা না থাকলে যে সরকারের সঠিক নীতিও অস্বচ্ছ ও অকার্যকর হয়ে যায়, সেটাও এবার দেখা গেছে।’ তিনি বলেন, ‘তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি যাই হোক না কেন, তার সুফল যে সমভাবে ও যথাযথভাবে বণ্টিত হয়নি, অতিমারির ধাক্কায় টিকে থাকার ক্ষমতা পিছিয়ে থাকা মানুষদের যে অনেক কম, সেটা প্রকাশ পেয়ে গেছে।’ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সমাদৃত এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি আরো বলেন, ‘এক দশক ধরে যারা উচ্চ প্রবৃদ্ধির সন্তোষের মধ্যে বৈষম্যের কালো ছায়া নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলো, কিন্তু যুক্তিতর্ক দিয়ে কিছু বোঝাতে পারেনি, করোনা সেটা খুব নিষ্ঠুরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে।’ সরকারের গৃহীত কর্মসূচি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেটা সঠিকভাবেই করেছে। সেটা সঠিকভাবেই করেছে। কিন্তু আগেও আমরা বলেছি, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন দরকার, তাদের আরও শক্তিশালী করা দরকার। এর অভাবেই সরকার তৃণমূল পর্যায়ে তার সাহায্য ও সহযোগিতা পৌঁছাতে চেয়েও সেটা পারল না।’
ড. দেবপ্রিয় মনে করেন, ‘করোনা কেটে গেলেও এর অভিঘাত অনেক দিন ধরে থাকবে। কারণ, সমস্যাটা নীতির বিষয় নয়, কাঠামোর বিষয়। নীতি যতই ভালো হোক না কেন, প্রতিষ্ঠান যদি না থাকে, কাঠামোগত অসুবিধা যদি থেকে যায়, তাহলে ভালো নীতিও অনেক সময় সুফল দিতে পারে না। পয়লা বৈশাখে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে কয়েকটি বিষয় তিনি সঠিকভাবেই বলেছিলেন। যেমন সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে, ব্যক্তি খাতে প্রণোদনা দিতে হবে, তারল্য বাড়াতে হবে। কিন্তু এসব ভালো নীতি কার্যকর করতে গিয়ে বাংলাদেশের দুর্বল প্রশাসন, দুর্বল স্থানীয় সরকার, দুর্বল রাজনৈতিক সংস্কৃতি, কার্যকর গণতন্ত্রের অভাব, বহুমতের জায়গা না থাকা এবং দুর্বল তথ্যপ্রবাহ ইত্যাদির কারণে সেই পরিমাণ সুফল তিনি নিয়ে আসতে পারেননি। এই মুহূর্তে আলোচনা বা বিতর্ক নীতি নিয়ে নয়, তার চেয়ে বেশি বাস্তবায়ন নিয়ে।’
এরকম অবস্থায় করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নীতি সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অস্বীকারের মনোভাব, তথ্যের প্রতি অবজ্ঞা এবং যারা সমালোচনামূলক কথা বলে, তাদের বৈরী বলে চিহ্নিত করা। পুরো বিষয়টাকে এমনভাবে অস্বীকৃতির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়, যাতে মেধার তুলনায় আনুগত্যের গুরুত্ব বেড়ে যায়। এই অস্বীকৃতির মনোভাব থেকে সবাইকে বের হতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন দরকার।’
দেশের উন্নয়নের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নিজের সন্দেহের কথা জানিয়ে বলেন, ‘যেসব আন্তর্জাতিক প্রাক্কলন আমরা পাই, তা আমি সঠিক বলে মনে করি না। তাদের যে তথ্যভিত্তি, সেটি পরিবর্তিত হতে থাকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপরও তা নির্ভরশীল। আর বিদেশি আন্তর্জাতিক সংস্থা বলেছে বলেই আমাদের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা তুচ্ছ হয়ে গেল, সেটি মনে করারও কোনো কারণ নেই।’
সরকারকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরকারকে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ বাড়াতে হবে। সম্পদ বাড়ানোর জায়গা হচ্ছে কর আহরণ বৃদ্ধি। এ জন্য করের মাত্রা নয়, পরিধি বাড়াতে হবে। এখানে যত ধরনের তছরুপ আছে, দুর্নীতি আছে, দেশ থেকে টাকা পাচারের বিষয় আছে, সব বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরি। ব্যবহারের দিক নিয়ে আলোচনা করলে এখন তো চোখ বন্ধ করে বলা যায়, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বছর বছর বাড়িয়ে আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময়ে যদি এই খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ৩ শতাংশ বাড়ানো না যায়, তাহলে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিহীনতা নিয়ে বড় সমস্যা তৈরি হবে। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের একটি সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কথা চিন্তা করার। এতে অল্প অল্প করে হলেও অর্থায়ন দেওয়া প্রয়োজন।’
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরো বলেন, ‘আমি মনে করি, বিকাশমান মধ্যবিত্তের চাওয়া–পাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। তাদের চাওয়া–পাওয়া মেটানোই হবে আগামী দিনের রাজনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ধনতন্ত্রের গহ্বরে ধনতন্ত্রের গোরখোদকের জন্ম হয়। কথাটাকে ঘুরিয়ে বলা যায়, উচ্চতর প্রবৃদ্ধির গহ্বরেই এই প্রবৃদ্ধির অন্যায্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো মধ্যবিত্তের জন্ম হবে। সুতরাং বাংলাদেশের আগামী দিনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিকাশমান মধ্যবিত্তের বড় ভূমিকা আমি দেখছি।’
সূত্র : প্রথম আলো
আপনার মতামত জানানঃ