সারা দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। আক্রান্ত বাড়ছে শিশুদের মধ্যেও। ঢাকা মেডিকেলেও প্রতিদিন গড়ে করোনায় আক্রান্ত ২০ শিশু ভর্তি হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার ঢাকা শিশু হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ১৮ জন রোগী ছিল। ইউনিটের ২০ শয্যার সব কটিই পূর্ণ ছিল বুধবারে। বৃহস্পতিবার ১০ দিন বয়সী এক নবজাতক মারা যায়, যার রক্তে সংক্রমণ ও নিউমোনিয়া ছিল। পরে করোনাও ধরা পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের মধ্যে যারা আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই অন্যান্য জটিল রোগে আগে থেকেই আক্রান্ত
শিশু সংক্রমণের পতিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত করোনায় শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী ৫৪ জন মারা গেছে। এ ছাড়া ১১ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে মারা গেছে ১০৯ জন। গতকাল অধিদপ্তর ২৪ ঘণ্টায় ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী ২ জনের মৃত্যুর তথ্য দেয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগেও করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এ বিভাগের করোনা ইউনিটে ৩১টি শয্যা আছে। গড়ে প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ জন ভর্তি থাকছে।
শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ইফফাত আরা শামসাদ বলেন, বছরের শুরুতে গড়ে পাঁচ–ছয়জন করে রোগী আসত। এখন রোগী অনেক বেড়েছে। কখনো পুরো ইউনিটও ভর্তি থাকে। এ সপ্তাহে একটি শিশু মারা যায়। শিশুটির লিউকোমিয়া ছিল।
ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৩২৬ শিশুর শরীরে করোনা ধরা পড়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ১১০ জন। এদের প্রায় সবারই অন্য রোগ ছিল।
এদিকে, শিশু হাসপাতালে এ পর্যন্ত ৫২৩ শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ৩২ জন, যাদের অন্য জটিল ছিল।
শিশু হাসপাতাল গত সপ্তাহে ১ হাজার ৪০০ নবজাতকের ওপর করা একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, নবজাতকদের ২ শতাংশ অর্থাৎ ৩২ নবজাতকের করোনা ধরা পড়ে।
এর মধ্যে এক দিন বয়সী দুই নবজাতক ছিল। এ ছাড়া শরীরে করোনার উপস্থিতি নিয়ে মৃত্যু হওয়া নবজাতকের সংখ্যা ৭, যারা অন্য রোগেও আক্রান্ত ছিল।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের মধ্যে যারা আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই অন্যান্য জটিল রোগে আগে থেকেই আক্রান্ত। তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায় এবং সহজেই তারা করোনায় সংক্রমিত হয়।
যেসব শিশু মারা গেছে, তাদের প্রায় সবার জটিল রোগ ছিল। এ ছাড়া ঢাকা শিশু হাসপাতাল এক গবেষণা করে দেখেছে, নবজাতকদের ২ শতাংশ করোনায় সংক্রমিত।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ বলেন, এক দিন বয়সী এক বাচ্চার মা ছিলেন আরেক হাসপাতালে। বাচ্চার করোনা ধরা পড়ার পর মায়ের করোনা পরীক্ষা করানো হয় এবং নেগেটিভ আসে।
তিনি বলেন, যে ৩২ নবজাতকের করোনা ধরা পড়ে, তাদের ২৬ জন মায়ের করোনা পরীক্ষা করা হয়। তাতে মাত্র ৩ জনের পজিটিভ ধরা পড়ে।
তিনি বলেন, ‘গবেষণাটি থেকে আমরা ধারণা করছি যে মা ছাড়াও বাচ্চাদের অন্য যে পরিচর্যাকারী আছেন, তাঁদের মাধ্যমে বাচ্চারা আক্রান্ত হচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, যে শিশুরা এখন করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি আছে, তাদের সঙ্গে থাকা মায়েদের সবার করোনা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু অধিকাংশই আক্রান্ত নন। পাঁচ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের তাদের পরিচর্যাকারীদের মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
অধ্যাপক ইফফাত আরা বলেন, যেসব শিশু অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত থাকে, তারা সহজে সংক্রমিত হয়। এ জন্য যেসব বাচ্চারা বিভিন্ন অসুখে ভুগছে, তাদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বাড়তি সতর্কতা দেখাতে হবে। এই শিশুরা নাজুক থাকে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ সফি আহমেদ বলেন, বড়দের মাধ্যমেই শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের করোনা হলেও উপসর্গ খুব সামান্য থাকে।
শিশু আক্রান্ত হলে তাদের মাধ্যমে বয়স্ক ব্যক্তিদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ঘরে শিশু ও বয়স্ক থাকলে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি সাবধানে থাকতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে শিশুদের কাছে যাওয়া যাবে না।
শিশুদের করোনা টিকা
বাংলাদেশে টিকা দেয়ার নূন্যতম বয়স রাখা হয়েছে ৩৫। নূন্যতম বয়স ১৮ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে শিশুদের সংক্রমণ বৃদ্ধিতে টিকার এই নীতি চিন্তায় ফেলছে বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে, সারা বিশ্বে জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য এখন অব্দি তেরোটি কোভিড-১৯ টিকার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর কোনটিই শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত নয়, যারা কিনা করোনা ভাইরাসে কম ঝুঁকিপূর্ণ।
এই পরিস্থিতি হয়তো বদলে যাবে। গত ১৬ই মার্চ মর্ডানা, আমেরিকান ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা, ঘোষণা দিয়েছিল যে ছয় মাস থেকে বারো বছরের শিশুদের টিকা দেয়া শুরুর ক্ষেত্রে তারা অনেকটাই এগিয়েছে। ট্রায়াল চলছে।
ফাইজার, আরও একটি আমেরিকান প্রতিষ্ঠান, বারো বছরের বেশি বয়সী শিশুদের উপর তাদের টিকার পরীক্ষা চালাচ্ছে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা, একটি ব্রিটিশ-সুইডিশ কোম্পানি, খুব শিঘ্রই ছয় থেকে সতেরো বছর বয়সী শিশুদের উপর টিকার ট্রায়াল শুরু করবে।
এদিকে একটি প্রতিবন্ধকতাও আছে। প্রাপ্তবয়স্কদের উপর কোভিড-১৯ এর যে সব ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়েছে, সেগুলো শিশুদের থেকে ভিন্ন। শিশুদের উপর চালানো ট্রায়ালে দেখা হবে, টিকা নেয়ার পর তাদের শরীরে কী পরিমাণ এন্টিবডি তৈরি হচ্ছে, তাদের শরীরে কি প্রাপ্তবয়স্কদের মতো একই সুরক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠছে (যদিও ট্রায়ালে আরও কিছু বিষয় দেখা হয়- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, কেইস নাম্বার এবং লক্ষণ)।
পাশাপাশি ট্রায়ালে শিশুদের সংখ্যা বেশ কম হয়; সেক্ষেত্রে ইতিমধ্যে টিকা গ্রহণ করা প্রাপ্তবয়স্কদের উপর চালানো ট্রায়ালে প্রাপ্ত এন্টিবডির পরিমাণ সম্পর্কিত তথ্য এবং অন্যান্য ফ্যাক্টগুলো যা সারস-কভ-২ এর ক্ষেত্রে ইমিউনিটি তৈরির বিষয়ে জানতে বুঝতে সাহায্য করে, তার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য তো থাকবেই।
মর্ডানাকে এখানে উদাহরণ হিসাবে দেখানো যায়। এটি ৩০ হাজার মানুষের উপর তাদের ফেজ-থ্রি ট্রায়াল চালিয়েছিলো। যার মাধ্যমে তারা প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দেয়ার জন্য আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন থেকে অনুমোদন পায়।
কিন্তু শিশুদের উপর মর্ডানার সাম্প্রতিক ট্রায়ালে মাত্র ৬ হাজার ৭৫০ জন অংশগ্রহণকারী আছে। তাই পার্থ্যকটা এখানে সুস্পষ্ট।
আপনার মতামত জানানঃ