দূর্নীতি এবং দালালি নেই এমন সেক্টর দেশের কোনো পেশাতেই নেই। তবে সবচেয়ে বেশি দালালি যে ডাক্তারী পেশাতে, তা অবস্থাই বলে দেয়। ডাক্তারী সবচেয়ে বেশি মানবিক পেশা হলেও, কারও কারও কাছে ডাক্তারী টাকা উপার্জনের পথ ছাড়া আর কিছুই না। তাই তো রোগীদের রোগ-বালাই, ভোগান্তি সবই তাদের কাছে ব্যবসা। এদিকে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে ইক্যুইপমেন্টের জন্য সরকারি অর্থ লুটে নেবার ঘটনাও অহরহ ঘটছে। সবদিক দিয়ে বলির পাঠা হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
বেসরকারী হাসপাতালগুলোর কমিশন বাণিজ্য
সঙ্ঘবদ্ধ দালাল চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলছে কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্যের কারণে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো রোগী ধরার ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এ কারণে ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালের করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সিট ও কেবিন ব্যতীত অন্য সিট ও কেবিন খালি পড়ে থাকে। হাসপাতালে ২৫টি অপারেশন থিয়েটার থাকলেও চালু রয়েছে মাত্র ৩টি। বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার থেকে ১৩-১৪শ রোগী ভিড় করেন। কিন্তু এখানে আগে থেকেই ওতপেতে থাকা দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে যেতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা। এক্ষেত্রে অনেক সময় চিকিৎসকরাও পরামর্শ দিয়ে থাকেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এজন্য তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ‘টোকেন মানি’ নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। পিসিআর ল্যাবে করোনা টেস্ট ও চিকিৎসা ছাড়া নামমাত্র চলছে অন্যান্য চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা। দুপুরের পর এ মেডিকেলের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকার অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কোয়ার্টারে না থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করেন। দুপুর না গড়াতেই তারা মেডিকেল কলেজ ত্যাগ করে বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বেসরকারি ক্লিনিক কিংবা প্রাইভেট চেম্বারে বসে রোগী দেখেন। বিষয়টি অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও চিকিৎসকদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।
এছাড়া হাসপাতালে রয়েছে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ তীব্র জনবল সংকট। টেকনিশিয়ন সংকটের কারণে ২৫টি অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে তিনটি চালু রয়েছে। বাকি ২২ অপারেশন থিয়েটারের কোটি কোটি টাকার মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও সরাঞ্জামাধিসহ তালাবদ্ধ রয়েছে। এদিকে আধুনিক সুবিধাসমৃদ্ধ কোয়ার্টার প্রস্তুত থাকলেও অধিকাংশই এখনও ফাঁকা পড়ে আছে। জানা যায়, চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশ রোগীই বহির্বিভাগের আশপাশে ওতপেতে থাকা দালাল চক্রের খপ্পরে পড়েন। গুনতে হয় ‘গলাকটা’ ফি।
এছাড়া সকাল থেকে টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ পাওয়া রোগীদের দুপুর একটা পর্যন্ত দেখেই চিকিৎসকরা চেয়ার ছেড়ে হাওয়া হয়ে যান। ফলে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অধিকাংশ রোগীকেই দুপুর ১টায় বাধ্য হয়েই বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কিংবা ক্লিনিকে যেতে হয়।
সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি কেনার অজুহাতে টাকা লুটপাট
গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের এমআরআই, সিটি স্ক্যান ও ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন দীর্ঘদিন ধরে অকেজো থাকায় রোগীরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এমআরআই মেশিনের হিলিয়াম গ্যাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর ৬ বছর পার হয়ে গেলেও তা আর চালু করা সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সালে সাড়ে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতালের জন্য এমআরআই মেশিন ক্রয় করে। মেশিনটি কিছুদিন চালু থাকার পর হিলিয়াম গ্যাস শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
২০১৩ সালে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের জন্য প্রায় ১০ কোটি ৬৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা ব্যয়ে সিটি স্ক্যান মেশিন ও ২০১৪ সালে ১০ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে ডিজিট্যাল এক্স-রে মেশিন ক্রয় করা হয়।
যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সিটি স্ক্যান মেশিন ও সফটওয়্যার নষ্ট হওয়ার কারণে ডিজিট্যাল এক্স-রে মেশিন ৬ মাস ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। হাসপাতালে দক্ষ টেকনোলজি থাকায় তারা কেবল এসব মেশিন অপারেট করতে পারেন। কিন্তু মেশিনের ত্রুটি চিহ্নিত ও মেরামত করতে পারেন না। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতারের পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় এক্স-রে কক্ষের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন রোগীরা। অধিকাংশ রোগী এক্স-রে না করতে পেরে বিভিন্ন ক্লিনিকে গিয়ে উচ্চ মূল্য এক্স-রে করছেন। এক্স-রে কক্ষের উত্তর দিকে রয়েছে সিটি স্ক্যান মেশিনের কক্ষ। ওই কক্ষটি বন্ধ রয়েছে, পাশের কক্ষে দু’জন টেকনোলজি বসে আছেন। জানতে চাইলে তারা বলেন, মেশিন নষ্ট থাকায় আমরা সিটি স্ক্যান করতে পারছি না। আর এমআরআই মেশিনতো অনেক আগেই অকেজো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাসপাতালগুলিকে শুধুমাত্র টাকা উপার্জনের কেন্দ্র করে তোলার পেছনে যতটা মানবিকতার বিপর্যয় দায়ি, ততটাই দায়ি সরকারের কাছ থেকে পাওয়া স্পর্ধা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২১৫৬
আপনার মতামত জানানঃ