বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা মার্চের ১ তারিখ থেকে নিজ প্রতিষ্ঠানে ডিউটি শেষে ওই হাসপাতালেই প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুবিধা পাবে, অর্থাৎ টাকা নিয়ে রোগী দেখতে পারবে। অর্থাৎ এখন থেকে ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালেই দেখতে পারবেন প্রাইভেট রোগী। এর ফলে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের আর বাইরে ব্যক্তিগত চেম্বার, ক্লিনিক, ফার্মেসি কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে রোগী দেখতে হবে না।
গত রোববার (২২ জানুয়ারি) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক জরুরি সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এসব কথা জানান। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে এই কার্যক্রমকে বলা হচ্ছে ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস। এখানে প্রশ্ন উঠছে, মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত কাদের জন্য? ডাক্তারদের জন্য? নাকি রোগীদের জন্য? কাদের সুবিধার জন্য এমন সিদ্ধান্ত? কারণ অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলছেন, এই সিদ্ধান্তে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সেবা ব্যহত হতে পারে।
কেন এমন সিদ্ধান্ত?
বাংলাদেশের সব সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকরা রোগী দেখেন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এরপর বেশিরভাগ চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখে।
প্রাথমিকভাবে সরকারি হাসপাতালে রোগী দেখা শেষে বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এতে একজন রোগীর বাইরে ডাক্তার দেখাতে যে খরচ হয়, তার চেয়ে কম খরচে ভালো সেবা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকরা বাইরে যত ফি নেয়, নিশ্চয়ই নিজের প্রতিষ্ঠানে প্র্যাকটিস করার সময় খরচ কমাবে। তাছাড়া সব রোগীর ফি তো সমান হবে না। এতে রোগীরা কম খরচে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে পারবে। যারা ভর্তি আছে, তারাও চিকিৎসা পাবে। সরকারি হাসপাতালে একসাথে অনেক ডাক্তার পাওয়া যাবে।’
এতে সরকারি হাসপাতালে কোনো চিকিৎসককে জরুরি প্রয়োজন হলে তাকে পাওয়াটা সহজ হবে। সেই সাথে সরকারি চিকিৎসকরা ধীরে ধীরে বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নিরুৎসাহিত হবে বলে সরকার আশা করছে।
প্রাথমিকভাবে ২০টি জেলা, ৫০টি উপজেলা হাসপাতাল, ও পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজে এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হবে। এ নিয়ে নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে বলেও মন্ত্রী জানান।
সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ যেখানে
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল জানান, সরকার এই প্রথমবারের মতো ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিসের বিষয়টি সামনে আনলেও ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০১১ সাল থেকে রোগীদের বৈকালিক সেবা দেয়া হচ্ছে।
হাসপাতালের কর্মঘণ্টা শেষে ২৬টি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা শুক্র ও শনিবার বাদে বাকি পাঁচ দিন ২০০ টাকা ভিজিটে রোগী দেখে। এই প্রাকটিস চলে বিকেল পর্যন্ত। এজন্য বেলা আড়াইটা থেকে বহির্বিভাগের বিশেষ সেবার টিকেট বিক্রি শুরু হয়।
সেই বৈকালিক কন্সাল্টেশন আদৌ কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে সে বিষয়ে কোনো মূল্যায়ন না করেই সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু করার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি বলে জানান তিনি।
আবু জামিল ফয়সাল বলেন, যখন এই সার্ভিস শুরু হয় তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সিনিয়র অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও রোগী, সবারই অনেক উৎসাহ ছিল।
পরে দেখা যায় সিনিয়র কেউ আর বসে না। তারা জুনিয়র মেডিক্যাল অফিসারদের বসিয়ে দিয়ে আগের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের জায়গায় চলে যায়। অর্থাৎ বাস্তবিক অর্থে এই সেবা কার্যকর হয়নি। এই বিষয়গুলো মূল্যায়নের পর সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার ছিল।
অভিযোগ রয়েছে সরকারি হাসপাতালের বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সময় একজন চিকিৎসক যতটা আন্তরিক থাকেন নিজের হাসপাতালে তা দেখা যায় না। আবার অনেক সময় হাসপাতালে না গিয়ে শুধু বেসরকারি চেম্বারে রোগী দেখার অভিযোগও বহুদিনের।
এমন অবস্থায় সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু হলে অনেক চিকিৎসক এর সুযোগ নিতে পারবে এবং তেমনটা হলে সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা আরো প্রশ্নের মুখে পড়বে বলেও আশঙ্কা করছেন আবু জামিল ফয়সাল।
তিনি বলেন, সরকারি সেবা দেয়ার সময়ে রোগী আসলে ডাক্তার তাদেরকে ‘এখন ব্যস্ত আছি’ বলে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সময় আসতে বলতে পারে। তারপর তিনি এক ঘণ্টা কোনো রকমে রোগী দেখে চলে যেতে পারে প্রাইভেট চেম্বারে। এরপর তাকে দেখাতে হলে প্রাইভেট চেম্বারেই যেতে হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আগের মতো মেডিক্যাল অফিসারদের দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালিয়ে নিতে পারে। এতে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার পরিসর ও মান ব্যহত হবে, রোগীরা সরকারি সেবা বঞ্চিত হবে। ফলে এই সিদ্ধান্তে কোনো লাভ হবে না বলে তিনি মনে করেন।
সুবিধা কার- রোগীর না ডাক্তারের?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেনিন চৌধুরীর মতে, সরকার সামগ্রিক জনগোষ্ঠীকে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা দেয়ার পরিবর্তে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসকে সহজতর করার ওপর জোর দিচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশের সব মানুষকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়া। এটা যদি সরকারের নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে সম্ভব না হয় সরকারি ও বেসরকারি জনবলের সমন্বয়ে করা দরকার। তাহলে স্বাস্থ্যসেবা খাতের বিকাশ সম্ভব। প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিস্তার ঘটানো সরকারের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত না।
তার মতে, আগে ঠিক করা দরকার যে সরকার কত মানুষকে তার নিজস্ব জনবল দিয়ে চিকিৎসা দিতে পারবে। সেটা যদি ৪০ শতাংশ হয়, তাহলে সেই ৪০ শতাংশ মানুষকে যেন মানসম্পন্ন চিকিৎসা দেয়া যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। বাকি ৬০ শতাংশ রোগীকে যদি বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে সেবা নিতে হয় তাহলে সরকারের উচিত হবে সেটার মান নিশ্চিত করা ও সেবার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা।
সরকারি খাতে যখন সেবা দেয়া হবে তখন চিকিৎসকের ভিজিট ফি-এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ওষুধ ইত্যাদি সরকারি অর্থে করার ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, অন্তত দরিদ্র থেকে অতি দরিদ্র ও প্রতিবছর চিকিৎসা নিতে গিয়ে যে ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে চলে যায়, তাদের জন্য ফ্রি সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তেমন পরিকল্পনা না করে সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিস্তার ঘটিয়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতে আদৌ কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসবে কিনা সেটা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।
এসডব্লিউএসএস/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ