স্বাস্থ্যসেবাকে ডিজিটাল করতে ডিজিটাল স্বাস্থ্য কার্ডের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ এটি বাস্তবায়িত হলে কার্ডধারীকে বাড়তি কোনো কাগজপত্র বহন করতে হবে না৷ কার্ডেই সব তথ্য থাকবে৷ চিকিৎসকও সেখান থেকে রোগীর আগের তথ্য পাবেন৷
পাইলট প্রকল্প হিসেবে কয়েকটি হাসপাতালে এই কার্ড ও কার্ডের মাধ্যমে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, প্রথমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে কয়েকটি হাসপাতালে এই কার্ড ও কার্ডের মাধ্যমে সেবা দেয়া হবে৷ পর্যায়ক্রমে সারাদেশে এটা বিস্তৃত হবে৷ পুরো কাজ শেষ হতে পাঁচ-ছয় বছর লেগে যাবে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, স্বাস্থ্য কার্ডের জন্য আলাদা ওয়েবসাইট হবে৷ সেই ওয়েবসাইটে অনলাইনে নিবন্ধন করে স্বাস্থ্য কার্ড পাওয়া যাবে৷ তবে যারা অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারবেন না তারা অনুমোদিত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নিবন্ধন করাতে পারবেন৷ নিবন্ধনের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বা ১৮ বছরের কম বয়সিদের জন্য জন্ম নিবন্ধনের অনুলিপি নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে৷ হাসপাতালের নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে বিনামূল্যে এই কার্ড করা যাবে৷ প্রতিটি নাগরিকের একটি নিজস্ব হেলথ আইডি নম্বর থাকবে৷ স্বাস্থ্য কার্ডের আওতায় আসা একজন রোগীর ‘জন্ম থেকে মৃত্য’ পর্যন্ত স্বাস্থ্য সেবার সব তথ্য ডিজিটাল ডেটাবেসে সংরক্ষণ করা থাকবে৷
এই কাজের জন্য সরকারি হাসপাতালগুলো অটোমেশনের কাজ আগেই শুরু হয়েছে৷যেসব বেসরকারি হাসপাতাল নিজস্ব অটোমেশন সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, তারা তাদের সফটওয়্যারকে ‘শেয়ারড হেলথ রেকর্ডসের’ সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারবেন৷ যেসব বেসরকারি হাসপাতালের নিজস্ব সফটওয়্যার নেই এবং নতুন কোনো সফটওয়্যার তৈরি করতে চাচ্ছে না, তাদের সংযুক্ত করতে একটি সফটওয়্যার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেয়া হবে৷
এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের জন্য নির্বাচন কমিশন এবং জন্ম নিবন্ধনের জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তি হয়েছে৷
কার্ডে নাগরিকের আগের চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র, পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব কাগজও থাকবে৷ অনলাইনেই সব তথ্য থাকায় হেলথ কার্ডের নম্বর দিলেই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট চলে যাবে রোগীর ইমেইলে৷ এর মাধ্যমে ঘরে বসেই রোগীরা হাসপাতালের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারবেন৷ বিভিন্ন হাসপাতালে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেই কার্ড বহন করলেই চলবে৷ এক কার্ডেই রোগীর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে যাবেন চিকিৎসকরা৷ চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, রোগ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকবে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (এমআইএস) এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে৷ গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর এবং মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায় পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথমে এই স্বাস্থ্য কার্ড দেয়া হবে৷ পরের ধাপে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কার্ড দেয়া হবে৷
সিংগাইর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. তাসনুভা মারিয়া ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা স্বাস্থ্য কার্ড দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি৷ সবকিছু সেটআপ করছি৷ লজিস্টিকস সাপোর্ট, ম্যানপাওয়ার, কার্ড দেওয়ার জন্য ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে৷ একই সঙ্গে রোগীদের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে হাসপাতালে আসার অনুরোধ করছি৷”
তিনি বলেন, ‘‘এখনো তারিখ ঠিক হয়নি, তবে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে এখানে প্রকল্পের কাজ শুরু হতে পারে৷ আমি যতটুকু জেনেছি তাতে যারা স্বাস্থ্য কার্ড পাবেন তাদের একটি ইউনিক আইডি নাম্বার থাকবে৷ ওটা দিয়ে সার্চ দিলেই তাদের আগের চিকিৎসা, রোগ সবকিছু জানা যাবে৷ সিংগাইর উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স থেকে একজন রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপা়তালে গেলে চিকিৎসক ওই রোগীর স্বাস্থ্য কার্ড থেকেই সব তথ্য পেয়ে যাবেন৷”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, একজন নাগরিকের প্রথম যখন হেলথ কার্ড হবে তখন যতদূর সম্ভব তার আগের চিকিৎসা, রোগ ও চিকিৎসাপত্রের বিস্তারিত তথ্য যুক্ত করা হবে৷ আগের ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার তথ্যও থাকবে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানান, ‘‘এর আগেও আমরা হেলথ কার্ডের বিষয়টি করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করেছি৷ দাতাদের অর্থায়নে ওই কাজগুলো হয়েছে, কিন্তু সাসটেইনেবল হয়নি৷ এবার আমরা ন্যাশনাল আইডি কার্ডকে সংযুক্ত করে কার্ডের কাজ করতে যাচ্ছি৷ কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সফটওয়াারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যুক্ত করা হবে৷ এটা কেমন কাজ করে তা আমরা আগামী বছর পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে পাঁচ-ছয় মাস দেখব৷ সফল হলে সারাদেশে বিস্তৃত করা হবে৷ আর আগের প্রকল্পের যে কাজ হয়েছে তাও আমরা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি৷”
তিনি বলেন, ‘‘এটা করা গেলে প্রত্যেকের একটা ইউনিক আইডি থাকবে৷ তিনি দেশের যে হাসপাতালেই যান না কেন ওই কার্ড দিয়ে চিকিৎসা নিতে পারবেন৷ তাকে সঙ্গে করে চিকিৎসার রেকর্ডপত্র বহন করতে হবে না৷ এই কার্ডে রোগীরা যাতে প্রতারিত না হন সেজন্য অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসসহ আরো কিছু তথ্য থাকবে৷”
তার কথা, ‘‘সরকার সবার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করতে চায় তার জন্য এই হেলথ কার্ড খুবই জরুরি৷ এটা করা গেলে এর মাধ্যমেই বাকি কাজ করা যাবে৷”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অর্ধাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এটি একটি ভালো উদ্যোগ৷ এর মাধ্যমে কার্ডধারী রোগীদের তথ্য ডিজটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষিত থাকবে৷ রোগ নির্ণয় করতে একই পরীক্ষা বার বার করতে হবে না৷ চিকিৎসকরাও সহজেই একজন রোগীর তথ্য জানতে পারবেন৷”
তার কথা, ‘‘এটা হতে পারে সবার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চিকিৎসা সেবার প্রথম পদক্ষেপ৷ এর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে হেলথ ইন্সুরেন্স যোগ করা যেতে পারে৷ সিনিয়র সিটিজেনদের বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং ওষুধের ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷ গরিব মানুষকেও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে৷”
এর আগে, চলতি বছরের শুরুতে দেশে সবার জন্য হেলথ কার্ড করা হবে বলে জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক৷ তিনি বলেছিলেন, সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আমরা ডিজিটালাইজড করছি৷ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজড করার কারণ হচ্ছে, দেশে সবার জন্য একটি হেলথ কার্ড হবে৷ এতে সবার স্বাস্থ্যের সব তথ্য থাকবে৷ অন্যান্য দেশেও এভাবে হেলথ কার্ড থাকে৷
আপনার মতামত জানানঃ