বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (শজিমেক) পঞ্চাশ টাকা বকশিশ কম দেওয়ায় অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেওয়ায় বিকাশ চন্দ্র (১৭) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) রাতে হাসপাতালের তৃতীয় তলায় সার্জারি বিভাগে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর রোগীর স্বজনরা চড়াও হলে আসাদুজ্জামান দুলু নামে ওই ওয়ার্ডবয় পালিয়ে যায়।
ওই স্কুলছাত্রের নাম বিকাশ চন্দ্র দাস। সে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার পুটিমারী গ্রামের বিশু চন্দ্র কর্মচারের ছেলে। স্থানীয় বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো বিকাশ। সে পড়াশোনার পাশাপাশি স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতো বলে জানান তার চাচা শচীন চন্দ্র কর্মকার।
মৃত্যুর পর তার স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, হাসপাতাল কর্মচারীকে ‘৫০ টাকা বকশিস কম দেওয়ায়’ তিনি রোগীর অক্সিজেন মাস্ক ‘খুলে নিয়েছিলেন’।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে রোগীর মৃত্যুতে শহরজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
চাচা শচীন চন্দ্র কর্মকার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পায় বিকাশ। প্রথমে স্থানীয় সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে সেখান থেকে পরে তাকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাকে শজিমেকে ভর্তি করা হয়। জরুরি বিভাগে বিকাশের চিকিৎসা শেষে মাথায় ব্যান্ডেজ এবং মুখে অক্সিজেনের নল দিয়ে তৃতীয় তলায় সার্জারি বিভাগের ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানে মেঝেতে একটি বেড দেওয়া হয়।’
‘এসময় রোগীর স্ট্রেচার বহনকারী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক কর্মচারী বিকাশের বাবার কাছে ২০০ টাকা বকশিশ দাবি করেন। এ সময় বিকাশের বাবা বিশু সেই কর্মচারীকে জানান, তার কাছে ২০০ টাকা নেই। ১৫০ টাকা আছে বলে তা সেই কর্মচারীর হাতে তুলে দেন। কিন্তু অভিযুক্ত কর্মচারী দুলু আরও ৫০ টাকা দাবি করলে আমার ভাই বিশু তা দিতে অসমর্থ হন। এতে দুলু রেগে যায় এবং বিকাশের মুখ থেকে অক্সিজেনের নল খুলে পা দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বিকাশের নাক-মুখ থেকে ফেনা বের হয় এবং তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। পরে ডাক্তার এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার আগেই এই কর্মচারী ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।’
শজিমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামীম বলেন, ‘রোগীর মৃত্যুর পর সেখানে উত্তেজনা দেখা দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ তৃতীয় তলায় গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু পুলিশ পৌঁছার আগেই ওই কর্মচারী পালিয়ে যায়।’
শজিমেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘দুলু কোন সরকারি কর্মচারী নন। মাঝে মাঝে সেখানে ডিউটি করত। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে সে দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা প্রহণ করা হবে।’
‘বিকাশের মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে আমরা অবগত হয়েছি। আজ এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে পরবর্তীতে যাতে এ ধরনের কোনো ঘটনা হাসপাতালে না ঘটে, সেই ব্যবস্থাও নেওয়া হবে’, বলেন ডা. আব্দুল ওয়াদুদ।
বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘ঘটনার পর সেখানে আমাদের পুলিশ কর্মকর্তা যান এবং ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। অভিযুক্ত কর্মচারী দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে হাসপাতালে কাজ করতো। সে এখন পলাতক। মরদেহ মর্গে রাখা হয়েছে। এখনও রোগীর স্বজন বা হাসপাতাল কৰ্তৃপক্ষ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে এরা সবাই হাসপাতালে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী। কিন্তু ওরা অবৈধভাবে জুড়ে বসেছে। নিজেদের পরিচয় দেয় ‘এক্সট্রা’ কর্মচারী হিসেবে। ওদের প্রাপ্তি বলতে রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া বকশিশ। কিন্তু এই বকশিশকে ওরা রীতিমতো জবরদস্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফলে ওদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ রোগী ও তাদের স্বজনরা। এমনকি দাবিমতো অর্থ না পেয়ে ওদের খামখেয়ালি আচরণে রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
তারা বলেন, এসব অবৈধ এক্সট্রা কর্মচারীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার ও সর্দাররা। তাদের যোগসাজশেই জরুরি ও বহির্বিভাগসহ প্রতিটি ওয়ার্ডে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে এসব অবৈধ কর্মচারী। বিনিময়ে ওদের দৈনন্দিন আয়ের একটি ভাগ তাদের দিতে হয়। ভাগ পান চতুর্থ শ্রেণির কিছু নিয়মিত কর্মচারীও। দিন দিন ওরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ