সম্প্রতি প্রবাসী রহিম শেখের মুমূর্ষু মা’র আইসিইউ সাপোর্টের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে জানিয়ে দেয়া হয় নির্ধারিত আইসিইউ সিটের বিপরীতে লম্বা সিরিয়াল রয়েছে ফলে বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনরা বেসরকারি হাসপাতালে যান। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধাকে বাঁচানো গেল না।
দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকে এই হাসপাতালে। ভর্তি থাকা এবং বহির্বিভাগের রোগীদের মধ্যে অনেকেরই আইসিইউ দরকার হয়। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের ভরসাস্থল এই হাসপাতালে আইসিইউ বেড আছে মাত্র ২০টি। এর মধ্যে দু-একটি প্রায় নষ্ট থাকে।
দেশে আইসিইউ সেবা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এখনো অনেক মুমূর্ষু রোগী প্রয়োজনে হাসপাতালে আইসিইউ’র সাপোর্ট পায় না। হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ’র অভাব প্রকট আকারে ধরা পড়ে করোনাকালে। আইসিইউতে শয্যা পাওয়ার জন্য সেখানে থাকা কারও মৃত্যু অথবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে হয় অন্য রোগীদের।
করোনার দৌরাত্ম্য কমলেও আইসিইউ’র অভাব আবার বোঝা যায় গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপের সময়। তিন বছর আগে প্রতিটি জেলা হাসপাতালে একটি করে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ৪৩টি জেলা হাসপাতাল ও ১০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ চালুর একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তবে এখনো সেইসব হাসপাতালে কোনো আইসিইউ সেবা চালু হয়নি।
সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক মানবজমিনকে জানান, ১৩টি জেলায় ১০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন হয়েছে। বাকিগুলোতে কাজ চলছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে মোট শয্যার ১০ শতাংশ আইসিইউ থাকতে হবে। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ যেন সোনার হরিণ। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩২টি সদর হাসপাতালে আইসিইউ নেই। করোনাকালে আইসিইউ’র জন্য যখন দেশ জুড়ে হাহাকার, তখন ২০২০ সালের ২রা জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। সাড়ে তিন বছর পার হলেও সে নির্দেশনা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। আইসিইউ থাকা হাসপাতালের অনেকগুলোতে নেই পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১ হাজার ১৮৫টি। এর মধ্যে ঢাকায় ৭২৮টি আর ঢাকার বাইরে ৪৫৭টি। ঢাকার সরকারি হাসপাতালে ৩৬৭ এবং চট্টগ্রামে সরকারি হাসপাতালে ৩৩টি আইসিইউ সাপোর্ট রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিটে যত রোগী ভর্তি থাকেন, অপেক্ষায় থাকেন তার চাইতে কয়েক গুণ বেশি রোগী।
ঢাকা বিভাগের মোট ১৩টি জেলার মধ্যে পাঁচ জেলার কোনো হাসপাতালেই আইসিইউ’র ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথ্য মতে, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, নরসিংদীতে ও শরীয়তপুরে এখনো আইসিইউ তৈরি হয়নি। চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার মধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় আইসিইউ নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়ও আইসিইউ সাপোর্ট নেই।
ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলার মধ্যে আইসিইউ রয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জামালপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বাকি নেত্রকোনা ও শেরপুরে আইসিইউ নেই। বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার মধ্যে বরিশাল ও পটুয়াখালী, ভোলা জেলায় আইসিইউ রয়েছে। ঝালকাঠি, বরগুনা ও পিরোজপুর জেলা হাসপাতালে আইসিইউ নেই বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথ্য বলছে। সিলেট বিভাগের চার জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় আইসিইউ নেই। রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলার মধ্যে নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে নেই।
খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে মাগুরা, ঝিনাইদহ এবং নড়াইল জেলা হাসপাতালে এখনো আইসিইউ নেই। রংপুর বিভাগের আট জেলার মধ্যে শুধু রংপুর ও দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ নেই।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার এত দিন পরও আইসিইউ প্রস্তুত না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের পরিচালক ডা. শাহ গোলাম নবী তুহিন বলেন, ১৩টি জেলার ১০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ চালু হয়েছে। বাকি ৩৫টি জেলা আইসিইউ’র জন্য ভবন প্রস্তুত করছে গণপূর্ত বিভাগ। যন্ত্রপাতি নভেম্বরের মধ্যে বসানো শেষ হবে।
তিনি দাবি করেন, লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার সমস্যা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং প্রকল্পটি বিলম্বিত হয়েছে। তিনি বলেন, ১০ মিলিয়ন ডলারের উপরে হলে আন্তর্জাতিকভাবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের মাধ্যমে যেতে হয়। এতে তারা কিছু সমস্যায় পড়ছেন।
আর ১০ মিলিয়নের নিচে হলে স্থানীয়ভাবে সমাধান করা যায়। কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি সংশোধন করে দেশীয় উৎস থেকে আর্থিক যোগান দেয়ার জন্য ২০২৫ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। তিনি জানান, প্রকল্পটিতে তাকে নিয়ে মোট চারজন পিডি পরিবর্তন হয়েছে।
দেশের খ্যাতিমান ভাইরোলজিস্ট, বিএসএমএমই’র সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম প্রকল্প বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির সমালোচনা করেন। ম্যানেজমেন্টের সমস্যার কথা বলেন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
এই বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম মানবজমিনকে বলেন, লোকবলের সংকট। যেগুলো বানানো হয়েছে সেগুলো তো ভালোভাবে চালু করা যায়নি। আইসিইউ পরিচালনার জন্য জনবল নিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এই বিষয়ে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়কে বলেছেন। আইসিইউ তো শুধু করোনা রোগীর জন্য না, সব মুমূর্মু রোগীর জন্য। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে কোভিড তো শেষ হয়ে গেছে।
আপনার মতামত জানানঃ