বাংলাদেশের ইতিহাসে গণ–অভ্যুত্থান এক বিশেষ রাজনৈতিক ভাষা হয়ে উঠেছে, যা জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও সংগ্রামের সর্বোচ্চ প্রকাশ। এটি শুধুই রাস্তায় মানুষের জড়ো হওয়া নয়, বরং এক দীর্ঘ পুঞ্জিভূত বঞ্চনার বিস্ফোরণ, যা কখনো ভাষার দাবিতে, কখনো রাজনৈতিক মুক্তির জন্য, কখনো বা জীবনের নিরাপত্তা, ভোটাধিকার, কিংবা সাম্যবাদের আকাঙ্ক্ষা থেকে বিস্ফারিত হয়। এই ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে আমরা দেখি—প্রথমে অনিয়ম, তারপর আন্দোলন, তারপর দমন, তারপর প্রতিরোধ এবং শেষে বিস্ফোরণ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যার সূচনা, তা পেরিয়ে এসেছে ১৯৬৯, ১৯৯০ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান পর্যন্ত।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল নিছক ভাষার প্রশ্ন নয়, ছিল পরিচয়ের প্রশ্ন, আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। এক অদৃশ্য শোষণব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রথম শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লিগ পরাজিত হয় এবং হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। এটাই ছিল পূর্ব বাংলায় গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষকাল। এরপর ১৯৬৯ সালে আমরা দেখেছি সত্যিকারের একটি গণ–অভ্যুত্থান, যেখানে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, রাজনৈতিক সংগঠন মিলিয়ে জনতার বুকে জেগেছিল সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ। এই অভ্যুত্থান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতা তৈরি করে দেয়।
স্বাধীনতার পর তিন বছরের মধ্যেই দেশ আবার স্বৈরতন্ত্রের কোলে ফিরে যায়। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যার পর সামরিক শাসনের এক গা-ছমছমে অধ্যায় শুরু হয়, যার ধারাবাহিকতায় আসে জিয়া ও এরশাদের শাসন। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ছিল এদেশের ইতিহাসে আরেকটি বড় গণ–অভ্যুত্থান। ছাত্র-জনতা, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দল—সবাই এক কণ্ঠে বলেছিল, ‘আর নয়।’ সেদিন ডা. মিলনের রক্ত ছিল শেষ স্পার্ক, যা আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল। এরশাদ পতনের পর দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচনের প্রচলন হয়। জনগণ ধরে নেয়—গণতন্ত্র এসেছে।
কিন্তু এই গণতন্ত্র ক্রমেই রূপ নেয় নির্বাচনকেন্দ্রিক লড়াইয়ে, যেখানে ভোট মানেই শুধু সংখ্যার হিসাব, আর দল মানেই ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পর থেকে নির্বাচন প্রক্রিয়া একচেটিয়া হয়ে উঠতে থাকে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের নামে যা হয়েছিল, তাকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলা যায় না। এরপর সরকার কার্যত মেয়াদোত্তীর্ণ, অনির্বাচিত অবস্থায় ক্ষমতা ধরে রাখে। ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান ছিল এই দীর্ঘ একনায়কতান্ত্রিক ধারা ও শোষণব্যবস্থার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বিস্তৃত ও জোরালো প্রতিক্রিয়া।
২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান ছিল পূর্ববর্তী অভ্যুত্থানগুলোর মতোই বৃহৎ, কিন্তু এর ছিল ভিন্ন চরিত্র। এখানে ছিল না কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্ব। ছাত্র, তরুণ, শ্রমজীবী মানুষ, নারী, ভিন্ন লিঙ্গধারার মানুষ, সংখ্যালঘু, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্যবাদে বিশ্বাসী অসংখ্য নাগরিক এ আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকার বাইরেও বহু জেলা ও গ্রামে। নানা চিত্র ও স্লোগান দিয়ে সারা দেশের দেয়াল কথা বলতে শুরু করে। কোনো রাজনৈতিক জোট নয়, বরং দেয়ালের গ্রাফিতি, ছাত্রদের প্ল্যাকার্ড, মিছিলের গান আর অস্থায়ী মঞ্চগুলো ছিল এ অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র।
এই অভ্যুত্থানও পূর্বসূরিদের মতোই রক্ত দিয়ে লেখা। যেমন ১৯৬৯ সালে আসাদ, ১৯৮৭ সালে নূর হোসেন, ১৯৯০ সালে ডা. মিলন—তেমনি ২০২৪ সালে পুলিশের গুলিতে রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যু ছিল ঘটনার টার্নিং পয়েন্ট। এরপর আন্দোলন আর থামেনি। একের পর এক প্রাণ হারায় শিক্ষার্থী, নারী, তরুণ শ্রমিক। সরকার যখন আন্দোলনকে দমনে আরও দমননীতি নেয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়, তখনই মানুষ বুঝে ফেলে—এবার থামা মানে মরে যাওয়া। ফলে অভ্যুত্থান ধীরে ধীরে সর্বব্যাপী হয় এবং শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতন ঘটে।
তবে ইতিহাস এখানে থেমে থাকে না। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়গুলোতে যা ঘটে, তা প্রতিবারই একটি নির্দিষ্ট ধারায় চলে। নতুন সরকার আসে, অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা তৈরি হয়, কিছু সংস্কারের উদ্যোগ দেখা যায়, কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে যে শক্তিগুলো আগে দমন করছিল, তারাই আবার অন্য নামে ফিরে আসে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়, সংবাদমাধ্যম চুপ থাকে, মব সন্ত্রাস বাড়ে, এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এক নতুন আতঙ্ক তৈরি করে।
২০২৪-এর গণ–অভ্যুত্থানের পরের সময়টাও এর ব্যতিক্রম নয়। ধর্মের নামে উগ্রবাদী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু সংখ্যালঘুরাই নয়, ইসলাম ধর্মের মধ্যকার সুফি, আহমদিয়া, বাউল সম্প্রদায়ের মানুষও ভয়-ভীতির মধ্যে বাস করতে থাকে। অনেক শিল্পকর্ম, সাহিত্যচিহ্ন, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকও আক্রান্ত হয়। এসবের পেছনে কেবল ধর্ম নয়, বরং অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক মালিকানা নিয়ে গোষ্ঠীগত দখলের এক নির্মম প্রতিযোগিতা কাজ করে।
এই পরিস্থিতি বারবার তৈরি হয়, কারণ জনগণ আন্দোলনে অংশ নিলেও, নেতৃত্বের জায়গা ছেড়ে দেয় কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর হাতে। যখনই নেতৃত্বের অভাব থাকে, অথবা নেতৃত্ব জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখনই আন্দোলনের বিজয় আপাত হলেও তা স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে না। এটাই ঘটেছে ১৯৬৯ ও ১৯৯০-এ, এবং এখন ২০২৪-এও সেই আশঙ্কা প্রকট হচ্ছে। গণ–অভ্যুত্থান শুরু হয় স্বপ্ন থেকে, কিন্তু শেষ হয় এক হতাশা দিয়ে—যখন দেখা যায়, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জায়গায় অন্য কেউ এসে বসে গেছে।
তিন স্বৈরাচারের পতনই ঘটেছে গণ–অভ্যুত্থানে: আইয়ুব, এরশাদ ও শেখ হাসিনা। তিনজনই উন্নয়নের নামে শাসন করেছেন, এবং তিনজনই পুঁজিবাদের বিকাশ ও বৈষম্যের বিস্তারে ভূমিকা রেখেছেন। তিন আমলেই জনগণ ‘উন্নয়নের গালগল্প’ শুনেছে, দেখেছে উন্নত সড়ক, উড়ালসেতু, জিডিপির উল্লম্ফন; কিন্তু সেই সঙ্গে দেখেছে আয়বৈষম্য, দখলদারি, গুম, জুলুম, হত্যা এবং মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারের পতন।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি—এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তিন আমলেই উন্নয়নের কারিগর হিসেবে নিজেকে জাহির করেছে। অথচ তারা কখনোই বৈষম্য নিয়ে কথা বলেনি। তাদের পরামর্শে তৈরি উন্নয়ননীতি বাস্তবায়িত হয়েছে জনগণের কণ্ঠ চেপে ধরে, এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে সামরিক-বেসামরিক আমলা, বড় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক এলিটদের হাতে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের গণ–অভ্যুত্থানগুলো কখনোই শুধুমাত্র নেতৃত্বের ইচ্ছায় হয়নি, হয়েছে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। কিন্তু সমস্যা তখনই শুরু হয়, যখন সেই অভ্যুত্থানদের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করে ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। জনগণ যখন নিজেরা স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিয়ে কোনো নেতা বা দলকে নিজের ভবিষ্যতের মালিক বানিয়ে ফেলে, তখনই সেই অভ্যুত্থান তার শক্তি হারায়।
২০২৪-এর গণ–অভ্যুত্থান আবারও প্রমাণ করেছে—এই দেশের মানুষ বারবার জেগে উঠতে জানে, লড়াই করতে জানে, কিন্তু গণ–স্বপ্নকে গণ–মালিকানায় রূপ দিতে জানে না। যে দিন মানুষ নিজেই নিজের মুক্তির নেতৃত্বে আসবে, সেই দিন হয়তো এই চক্র থেকে বেরিয়ে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে।
আপনার মতামত জানানঃ