মুজিব রহমান
স্টিফেন হকিং তার দ্য গ্রান্ড ডিজাইন বইতে লিখেছেন, ‘দর্শন এখন মৃত’। কেন এমনটা বলেছেন? বইটি পড়লে বোঝা যাবে যে প্রকৃতপ্রস্তাবে তিনি আক্ষরিক অর্থেই বলেছেন। দর্শনকে বলা হতো- জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা। দর্শনে অস্তিত্ব, জ্ঞান, মূল্যবোধ, কারণ, মন ও ভাষা সম্পর্কে সাধারণ ও মৌলিক প্রশ্নগুলোর অধ্যয়ন করে। জগৎ, জীবন, মানুষের সমাজ, তার চেতনা ও জ্ঞানের প্রক্রিয়া নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়। বিপরীতে বিজ্ঞানে দরকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণযোগ্য সৃশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা। সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডার হল বিজ্ঞান। দর্শনের ভাবনাটা প্রমাণ করতে হয় না। কিন্তু বিজ্ঞানতো প্রমাণের কথা বলে। বৈজ্ঞানিক প্রমাণেই বেরিয়ে আসে সত্যটা। তাই দর্শন এখন বাস্তবিকই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিপরীতে এখন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পরীক্ষার ফলও তাত্ত্বিক ভবিষ্যদ্বাণির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে। এটি কখনো কোন পরীক্ষার দ্বারা নিষ্ফল প্রমাণিত হয়নি। পদার্থবিদ ফাইনম্যানের একটি বক্তব্য খুব প্রচলিত। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় আমি এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, কেউই কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে বুঝতে পারে না’। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যের পরে বহু সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। সার্নে পরীক্ষা করে ঈশ্বর কণা নামে পরিচিত রহস্যময় হিগস বোসন কণার অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। অথচ এই কণা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা অনুমাণই কেবল করেছিলেন। আমাদের পৃথিবী কিভাবে নির্মিত তা বর্ণনা করা সহজ হয় এই আবিস্কারে। তাত্ত্বিক ভবিষ্যদ্বাণি এভাবেই প্রমাণিত হয় এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
পৃথিবী ও মহাবিশ্ব কিভাবে চলে? এক কথায় বললে বলতে হয়- প্রকৃতি নিয়ম দিয়ে শাসিত হয়। অর্থাৎ মহাবিশ্ব চলে পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনে। সূত্রগুলোর উৎপত্তি কোথা থেকে এলো? সূত্রগুলো ধর্মগ্রন্থগুলোতেই থাকা মানানসই ছিল। কিন্তু সেখানে তেমন কিছুই নেই। তাহলে কারা আবিষ্কার করলো সূত্রগুলো? যে মানুষগুলো পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন তারাই নিয়ে এসেছেন সূত্রগুলো। একটি পানির চৌবাচ্চায় নেমে আর্কিমিডিস যখন দেখলেন তিনি হালকা বোধ করছেন। কিছু ওজন হারিয়েছেন মানে উর্ধ্বমুখী চাপ উপলব্ধি করছেন। তিনি প্লবতার সূত্র বোঝতে পেরে ‘ইউরেকা!, ইউরোকা!’ বলে ছুট লাগালেন। আর নিউটনের পাশে যখন একটি আপেল পড়ল তখন তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণই বের করে আনল, মধ্যাকর্যণ শক্তির কথা। তিনি গভীর পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করেই বলবিদ্যার বিখ্যাত সূত্র তিনটি আবিস্কার করেন। এসকল সূত্র নিয়ে নিউটনের মধ্যে ধারণা ছিল, ‘ঈশ্বর শুরুতে সৃষ্টি করেছেন এবং আজ পর্যন্ত তাকে একই নিয়মে, একই অবস্থায় রক্ষা করে চলেছেন’। নিউটন মারা গেছেন প্রায় তিনশত বছর আগে। যখন আস্তিক্যবাদী দার্শনিকদের ব্যাপক প্রভাব ছিল এবং সময়টা ছিল রেনেসাঁর কাল। তখনো বস্তুবাদী দর্শন আসেনি। বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ফয়েরবাখের জন্মই নিউটনের মৃত্যুর ৭৭ বছর পরে।
আমরা আইনস্টাইনের একটি উদ্বৃতি খুব দেই। তিনি বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর যেন প্রতিটি জাগতিক ভৌত ঘটনার ভাগ্য নির্ধারণের আগে পাশা খেলছেন’। এ থেকে আমরা ধরে নেই তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন। বাস্তবিক তিনি চূড়ান্ত কথাটি বলেছেন তাঁর খ্যাতি পাওয়া বিখ্যাত ঈশ্বর চিঠিতে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘ঈশ্বর শব্দটি আমার কাছে আর কিছুই না, এটি হল মানুষের দুর্বলতার একটি বহিঃপ্রকাশ।’ একসময় দর্শনে ছিল আস্তিক্যবাদ ও নাস্তিক্যবাদ নিয়ে বিতর্কের স্থান। এরপর আসলো ভাববাদী ও বস্তুবাদী দর্শন নিয়ে বিতর্ক। বস্তুত বস্তুবাদী দর্শন ভাববাদী দর্শনকে প্রতিস্থাপন করেছে। কার্ল মার্ক্স নিয়ে এল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন। এতোকাল যা ছিল আলোচনায় সীমাবদ্ধ তার প্রয়োগ হল। কিন্তু তারপর .. ..
এখন সবাই সবকিছতেই প্রমাণ চায়। সেই প্রমাণতো প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে নেই, আছে শুধু বিশ্বাস! দর্শনও প্রমাণ করার দায় নিবে না। তাহলে? বিজ্ঞানেরই দায় রয়েছে সবকিছু প্রমাণ করার। তাই মনে হয় দর্শনকে বিজ্ঞানই অকার্যকর করে দিয়েছে। হকিং বলেছেন, ‘দার্শনিকগণ বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার ও তত্ত্বের সাথে আর পাল্লা দিতে পারছেন না’। অথচ দীর্ঘকাল ধরে বলা হচ্ছিল, ‘দর্শন হল সকল বিষয়ের প্রসূতি। সর্বক্ষেত্রে দর্শনের ভূমিকা রয়েছে এবং দর্শন থেকেই বিজ্ঞানের সৃষ্টি।’ পদার্থবিদ ড. সুশান্ত কুমার দাস স্যার সাম্প্রতিক ‘দ্য গ্রান্ড ডিজাইন’ বইটির বাংলা রুপান্তরের পাঠ উন্মোচন অনুষ্ঠানে বললেন, ‘হকিং আক্ষরিক অর্থে বলেন নি’। কিন্তু ‘দ্য গ্রান্ড ডিজাইন’ বইটিতে এমন কোন প্রমাণ মিলে না যে, তিনি আক্ষরিক অর্থে বলেন নি ‘দর্শন এখন মৃত’। আজ উল্টে গেছে সব- সেই প্রসূতি মাকে ছাড়িয়ে বিজ্ঞান অনেক দূরে চলে গেছে আর দর্শন রয়ে গেছে আঁতুড় ঘরেই। এখন বলা হচ্ছে, দর্শন জ্ঞানের ভিত্তি হতে পারে, হতে পারে আরো অনেক কিছু কিন্তু দর্শন বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞানের সীমানায় দর্শনের প্রবেশ নেই। মনোবিজ্ঞান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সবকিছুকেই এখন বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে হয়। আইনস্টাইন যখন বলে দেন, ‘ঈশ্বর হল মানুষের দুর্বলতার একটি বহিঃপ্রকাশ’ তখনতো সত্যের অলৌকিক সীমানাতেও তার প্রবেশ ঘটে যা এক সময় ছিল একান্তই দর্শনের বিষয়। বিজ্ঞান আত্মাকে অস্বীকার করার পরেই ধর্ম-দর্শনের উপর আঘাত চলে আসে। সেই আঘাত সহ্য করে টিকে থাকা ধর্ম-দর্শনের পক্ষে অসম্ভব হবে। বিষয় হিসেবে দর্শন, ভূগোল, ইতিহাস, সাহিত্য ইতোমধ্যেই গুরুত্ব হারিয়েছে। ভূগোলের সাথে অনেকে পরিবেশ যুক্ত করে একে বিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছেন। সাহিত্যের সাথে সংযুক্ত করে নিয়েছেন ভাষাকে।
দর্শন মৃত- এর কি কোন প্রমাণ হকিং এর কাছে ছিল? যদি না থাকে তবে একেও অনেকে বলবে দার্শনিক মত। আইনস্টাইনের কাছে কি এমন কোন প্রমাণ আছে যে, ‘ঈশ্বর হল মানুষের দুর্বলতার একটি বহিঃপ্রকাশ’। যদি না থাকে তবে সেটাও হবে দর্শন? তাদের কাছে যা আছে তা হল, যুক্তি ও পর্যবেক্ষণ আর সেটাও দর্শন বলে দাবি করবেন অনেকে। সেটা দার্শনিক মত হলেও আমাদের যৌক্তিক কারণেই মেনে নিতে হচ্ছে। হকিং ও আইনস্টাইন ভুল বলেছেন, এমনটা গ্রহণ করার কোন অবকাশ আমাদের নেই, কোন যৌক্তিক জায়গাও নেই। আবার আমাদের স্বীকার করতেই হবে, পৃথিবীর এই অগ্রগতিতে, মানুষের ভাবনার জগৎকে উন্নত করতে দর্শনই রেখেছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু আজকের পৃথিবী বিজ্ঞানের, সেখানে দর্শনের গুরুত্ব ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে- এটাও সত্য।
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ