করোনাকালে সরকার প্রদত্ত প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পাননি অধিকাংশ ব্যবসায়ী। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকারের দেওয়া প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা এখনও পাননি ৬৯ শতাংশ ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ী। আর প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে অবগত নন ৯ শতাংশ ব্যবসায়ী।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক যৌথ জরিপে এ চিত্র উঠে আসে। ‘কোভিড-১৯ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আত্মবিশ্বাস’ শীর্ষক এ জরিপ গতকাল রোববার এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় প্রকাশ করা হয়।
এক ওয়েবিনারে জরিপের ফল উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। আলোচক হিসেবে ওয়েবিনারে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান।
বাংলাদেশের ৮ বিভাগের ৩৬টি জেলার মোট ৫০৩টি ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ওপর এই জরিপ করা হয়। এর মধ্যে ২৫৩টি উৎপাদন খাতের এবং ২৫০টি সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠান। উৎপাদন খাতের তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, হালকা প্রকৌশল ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সেবা খাতের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, আইসিটি ও টেলিকমিউনিকেশন, আর্থিকখাত ও রিয়েল এস্টেটখাত জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০২১ সালের এপ্রিলের ৬ থেকে ১৮ তারিখের মধ্যে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদাধিকারীদের সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়।
জরিপে দেখা যায়, জরিপে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পেয়েছে। ৬৯ শতাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তারা প্রণোদনা প্যাকেজ পাননি এবং ৯ শতাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তারা প্যাকেজ সম্পর্কে জানেনই না। জরিপকৃত বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ পেয়েছে ৪৬ শতাংশ, মাঝারি ৩০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র ও ছোট প্রতিষ্ঠান ৯ শতাংশ।
জরিপের ফল তুলে ধরেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, করোনার শুরুর দিকে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা এসেছিল, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে এগিয়ে আছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো, পিছিয়ে ছোটরা। জরিপে অংশ নেওয়া ক্ষুদ্র ও ছোট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পুনরুদ্ধারের গড় হার প্রায় ৪৭ শতাংশ, মাঝারিদের মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশ এবং বড়দের ক্ষেত্রে তা ৭৭ শতাংশ।
জরিপে কোন কোন খাতে প্রণোদনা পাওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি, তা–ও উঠে আসে। দেখা যায়, সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে পোশাক ও বস্ত্র খাত। এ ছাড়া চামড়া, খাদ্য ও আর্থিক খাতে প্রণোদনা পাওয়া প্রতিষ্ঠানের হার বেশি। একেবারেই পিছিয়ে রয়েছে পাইকারি বিক্রেতা, রেস্তোরাঁ, পরিবহন ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত।
কেন প্রণোদনা পাওয়া যায়নি, প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েকটি কারণকে বড় করে দেখিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রণোদনা ঋণ হিসেবে দেওয়া, অনুদান নয়; প্রক্রিয়াগত জটিলতা, সংশ্লিষ্ট শিল্প খাতের জন্য আলাদা প্যাকেজ না থাকা, ব্যাংকবিষয়ক সেবার ক্ষেত্রে জটিলতা এবং প্রক্রিয়া বুঝতে না পারা।
জরিপের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, শ্রমঘন শিল্প বলেই যে তৈরি পোশাক খাত বেশি প্রণোদনা পায় তা নয়, তাদের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত জোরালো। এ কারণেই অন্যদের তুলনায় বেশি প্রণোদনা পায় তারা।
তিনি বলেন, কুটির ও ছোট শিল্প আরও শ্রমঘন। তবে তারা সরকারি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে।
সরকার করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে গত বছর প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। যার আওতায় কম সুদে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ব্যাংকগুলোর কাছে কুটির ও ছোট শিল্পগুলো একেবারেই উপেক্ষিত। এ জন্য কুটিরশিল্পকে কত ঋণ দিতে হবে, ছোট শিল্পকে কত দিতে হবে, মাঝারি ও বড়দের কত দিতে হবে—এ বিষয়ে লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া দরকার।
জরিপের একটি অংশ ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে কনফিডেন্স বা আত্মবিশ্বাস পরিস্থিতি নিয়ে। এতে উঠে আসে, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ব্যবসায়িক আত্মবিশ্বাসের প্রক্ষেপণ ছিল ১০০-এর মধ্যে প্রায় ৫৮। এপ্রিল-জুন সময়ের ক্ষেত্রে তা নেমে আসে ৪১-এ। মাত্র ২ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মনে করছে, এই সময়ে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে। করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তার জেরেই আত্মবিশ্বাসের সূচক এতটা কমেছে।
জরিপ বলছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর মাত্র ২ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, অর্থনীতি শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছে। মাঝারি মানের পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন ৩১ শতাংশ এবং দুর্বল মানের পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী।
জরিপে দেখা গেছে, হালকা প্রকৌশল, পরিবহন এবং রেস্টুরেন্ট খাতের ব্যবসায় আস্থা সবচেয়ে কম। ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার আস্থা সূচক ৩৯ দশমিক ০২, মাঝারি প্রতিষ্ঠানের ৪০ দশমিক ৮৩ এবং বড় প্রতিষ্ঠানের ৪৬ দশমিক ৬১।
আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অতি আত্মবিশ্বাস অর্থনীতিতে বিপদ ডেকে আনতে পারে। এটা ঠিক ছুরির দুই দিকের ধারের মতো। এতে করোনার ঝুঁকি আরও বাড়বে। কারণ, কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি মানেই মানুষের চলাচল বৃদ্ধি। এতে করোনার সংক্রমণ আরও বেশি হারে বাড়তে পারে। ভারত এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ। যেসব প্রতিষ্ঠান এখনও প্রণোদনার সহায়তা পায়নি, তাদের হাতে প্রণোদনা পৌঁছানোর কৌশল বের করার পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায় আস্থা বাড়ানোর জন্য সরকারকে খাতভিত্তিক গাইডলাইন তৈরি এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
কর প্রদানে হয়রানির অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ব্যক্তি ব্যক্তিকে হয়রানি করেন। কম্পিউটারের সিস্টেম সেটা করে না। হয়রানি বন্ধে গোটা ব্যবস্থা অটোমেশনের আওতায় আনার পরামর্শ দেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৮
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ