সম্প্রতি করোনাসময়ে প্রণোদনার ওপর বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রণোদনা প্রদানে পেছনের সারির দিকে রয়েছে বাংলাদেশ।
এ ক্ষেত্রে ঘানা ও ইথিওপিয়ার মতো দেশের থেকেও কম তারল্য সহায়তা দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ সরকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ২ শতাংশ আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু ঘানা ও ইথিওপিয়া দিয়েছে যথাক্রমে জিডিপির ৪ ও ৩ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২২’ বা বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ওয়াশিংটন থেকে মঙ্গলবার রাতে ‘সমতাভিত্তিক পুনরুদ্ধারের জন্য অর্থায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন আয় গ্রুপের ২৫টি দেশের জিডিপি অনুপাতে আর্থিক সহায়তায় চিত্র তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে ভিন্ন কথা।
বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের মতো। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, জিডিপির সাপেক্ষে ৪ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, যদিও যার বড় অংশ ঋণ আকারে দেওয়া হয়েছে। সরকার মূলত ব্যাংক সুদের একটি অংশ বহন করেছে।
নিম্ন আয়ের দেশগুলো গড়ে বাংলাদেশের মতো একই হারে প্রনোদনা দিয়েছে।
বৈশ্বিক হিসাব থেকে দেখা যায়, করোনাসময়ে ইতালি তার জিডিপির ৪৫ শতাংশ, জাপান ৪৩, যুক্তরাজ্য ৩৫, যুক্তরাষ্ট্র ২৮, ভারত ১২, বাংলাদেশ ৪ দশমিক ৫ এবং পাকিস্তান ২.৪ শতাংশ প্রণোদনা দিয়েছে। এতে সহজেই দেখা যাচ্ছে, নিম্ন আয়ের দেশগুলো প্রণোদনার দিক থেকে পিছিয়ে আছে।
বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে ভিন্ন কথা।
অন্যদিকে বাংলাদেশের বরাদ্দকৃত বেশির ভাগ প্রণোদনা পেয়েছে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের শিল্পগুলো অনেকটাই এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এতে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বড় হয়েছে ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।
বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, সারা দেশে ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন প্রায় ৮০ লাখ উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র কারখানা রয়েছে ৪০ হাজার ২৫০টি। আর বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, সারা দেশে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছেন প্রায় ৫৬ লাখ। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২০-২৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে।
অথচ গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক জরিপে জানা গেছে, মাত্র ৯ শতাংশের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার আওতাভুক্ত হয়েছে। যারা প্রণোদনা পেয়েছে, তাদের ব্যবসায়িক পুনরুদ্ধারের হার ৭১ শতাংশ এবং যারা প্রণোদনা পায়নি, তাদের পুনরুদ্ধারের হার ৫৮ শতাংশ।
করোনাসময়ে প্রণোদনার সুষ্ঠু বণ্টনের অভাবে দেখা দিয়েছে মারাত্মক আয়বৈষম্য। এতে যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, মুদ্রাস্ফীতির বাজারে তাদের টিকে থাকতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বিভিন্ন উন্নত দেশের সরকার সরাসরি মানুষের হাতে প্রণোদনার অর্থ পৌঁছে দিয়েছে। তাদের প্রণোদনার বড় একটি অংশ ছিল এই প্রত্যক্ষ সহায়তা। বাংলাদেশ সরকার দুই ধাপে ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষকে প্রণোদনার অর্থ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষমেশ তথ্যের অভাবে তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। এ ছাড়া অন্য কোনো নগদ সহায়তা প্রকল্প সরকারের ছিল না। ফলে অনেক মানুষ হারানো আয় আর পুষিয়ে নিতে পারেননি। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধাক্কা। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
এই বাস্তবতায় গত দুই অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধির হার নিয়েও অর্থনীতিবিদেরা সময়-সময় সংশয় প্রকাশ করেছেন।
প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে নিম্ন আয়ের মানুষের হাতেও অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে। সে জন্য ঋণদাতাদের ঋণের ধরন পরিবর্তন করতে হবে। সে জন্য আর্থিক খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনী সমাধান নিয়ে আসতে হবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর ভেতরে আর্থিক এবং খাদ্যসহায়তা খুবই কম। প্রণোদনার বড় অংশই হাইব্রিড। মূলত ব্যাংকনির্ভর ঋণে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। সরকার এমন কিছু প্রকল্প এখানে ঢুকিয়েছে যেগুলো আদৌ প্রণোদনা হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। প্রণোদনার মধ্যে প্রত্যক্ষ সহায়তার পরিমাণ খুবই সামান্য।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে করোনা মহামারিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষয়ক্ষতিসহ কয়েকটি জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। করোনার কারণে বিক্রি কমে যাওয়া ৪৬ দেশের তালিকা দেওয়া হয়েছে। এতে ওপরের দিকে রয়েছে বাংলাদেশ। করোনাকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাংলাদেশে বিক্রি কমে যায় প্রায় ৬০ শতাংশ। দক্ষিণ আফ্রিকায় সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ বেচাকেনা কমে যায়। এছাড়া শ্রীলংকায় ৭৫ শতাংশ, আফগানিস্তানে ৭৩ শতাংশ, নেপালে ৬৫ শতাংশ ও পাকিস্তানে ৫৫ শতাংশের চেয়ে বেশি বিক্রি কমে যায়।
অন্যদিকে ৪০টি দেশের ওপর পরিচালিত আরেক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ ঋণগ্রহীতা মনে করেন, করোনার প্রভাবে তাদের ঋণ যথাসময়ে ফেরত দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে এ হার সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ ও নেপালে ৮৫ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস বলেন, করোনা সংকট এবং অস্বচ্ছ ঋণের কারণে সৃষ্ট আর্থিক ভঙ্গুরতার ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিতে রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার বাড়ছে। এজন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে মজবুত ভিত্তির আর্থিক খাত গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যত করেই বলা হোক না কেন করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রণোদনা প্রদানে অনিয়মের বালাই এড়াতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে, যারা অনিয়ম ও দুর্নীতি করে তারা এসবের ফাঁকফোঁকর ঠিকই বের করে ফেলেন। তারা বলেন, করোনাকালে বাজার ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত হওয়ায় উৎপাদন ও বিপণন ব্যহত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। সংকটকালে সরকারের প্রণোদনা তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করার কথা থাকলেও এখন দেখা যাচ্ছে তার চিত্র উল্টো।
বলেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি শ্লথ। কোভিড সংকট শিগগিরই শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই নতুন এই পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় করে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল ঠিক করতে হবে। ঢাকায় যে ধরনের লকডাউন প্রযোজ্য হবে, রংপুরে সে ধরনের লকডাউন প্রযোজ্য নয়। আবার তৈরি পোশাক খাতের জন্য একধরনের কৌশল লাগবে, অন্যদের ক্ষেত্রে তা হয়তো প্রযোজ্য হবে না। তাই সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কৌশল ঠিক করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ