বৈশ্বিক মহামারি করোনায় সৃষ্ট অচলাবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক সংকট উ্ত্তরণে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা পায়নি ৭৯ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বাকি ২১ শতাংশের মতো প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার অর্থ পেয়েছে। আর প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা পেতে ঘুষ দিতে হয়েছে ২৯ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) ‘কোভিড-১৯ এবং বাংলাদেশে ব্যবসায় আস্থা’ শীর্ষক জরিপে ওঠে এসছে এই তথ্য। গত এপ্রিল থেকে জুনের পরিস্থিতি বিবেচনা করে গত জুলাইয়ে ৫০১টি প্রতিষ্ঠানের ওপর এই জরিপ করা হয়। এতে সহায়তা করেছে দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন।
শনিবার(২৮ আগস্ট) সকালে অনলাইনে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ জরিপের ৫ম ধাপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে জরিপের প্রক্রিয়া ও ফলাফল তুলে ধরেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান।
জরিপে বলা হয়, সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা পায়নি ৭৯ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কোনো টাকা পায়নি। আর ১৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে জানেই না। বাকি ২১ শতাংশের মতো প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার অর্থ পেয়েছে। বড়দের তুলনায় ছোট প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা কম পাচ্ছে।
জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে সানেম বলেছে, প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা দিতে কারও কারও কাছে ঘুষও চাওয়া হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ২৯ শতাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তাদের কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছে।
জরিপে বলা হয়েছে, আরও ৪৭ শতাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান ঘুষ দাবির বিষয়ে হ্যাঁ কিংবা না কোনো জবাব দেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানও ঘুষের শিকার হয়ে থাকতে পারে। মাত্র ২৪ শতাংশ জানিয়েছে, তাদের কাছে ঘুষ চাওয়া হয়নি।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, জরিপে নেওয়া ২৯ শতাংশ উদ্যোক্তা কিংবা তাদের প্রতিনিধিরা ঘুষ দাবির অভিযোগ করেছেন। ৪৭ শতাংশ হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই বলেননি। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ হিসেবে নিলে এরাও ঘুষের শিকার বলে ধরে নেওয়া যায়। তারা হয়তো নানান দিক থেকে ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই সরাসরি হ্যাঁ বলতে চাননি।
সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা পায়নি ৭৯ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কোনো টাকা পায়নি। আর ১৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে জানেই না। বাকি ২১ শতাংশের মতো প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার অর্থ পেয়েছে। বড়দের তুলনায় ছোট প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা কম পাচ্ছে।
শিল্প কিংবা সেবা প্রতিষ্ঠানের ধরন ব্যাখ্যা করে ড. সেলিম রায়হান বলেন, ঘুষের অভিযোগ তোলা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষুদ্র-মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই বেশি। মোট ৪২ শতাংশ এ ধরনের প্রতিষ্ঠান। ৩৫ শতাংশ ক্ষুদ্র আকারের প্রতিষ্ঠান।
ঘুষের দাবিসহ একরম বিভিন্ন কারণে জরিপে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জুলাই পর্যন্ত ৭৯ শতাংশ প্রণোদনা প্যাকেজের বাইরে রয়ে গেছে। অর্থাৎ মাত্র ২১ শতাংশ প্যাকেজ থেকে ঋণ সুবিধা পেয়েছে।
তবে ব্যাংক কিংবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ঘুষ দাবি করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি সানেমের পক্ষ থেকে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. সেলিম রায়হান বলেন, ঘুষ দাবি করা হয়েছে কিনা এ প্রশ্নের হ্যাঁ কিংবা না জবাবের বাইরে বিস্তারিত আর কিছু জানতে চাওয়া হয়নি জরিপে।
জরিপে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও প্রতিনিধিদের প্রশ্ন করা হয়েছিল— তারা নিজেরা (নিয়োগ কর্তা) এবং কর্মীদের কত শতাংশ টিকা পেয়েছেন? জবাবে ৬০ শতাংশই মালিক জানিয়েছেন, তারা কমপক্ষে এক ডোজ টিকা নিয়ে ফেলেছেন। আর কর্মীদের মধ্যে মাত্র সাড়ে ২৫ শতাংশ টিকা পেয়েছেন। ৭৫ শতাংশ কর্মী টিকার একটি ডোজও পাননি। তৈরি পোশাক খাতের কর্মীদের প্রতি পাঁচজনে একজন মাত্র টিকা নিতে পেরেছেন।
জরিপের মূল বিষয় ছিল ব্যবসার আস্থা। সানেম বলছে, গত এপ্রিল-জুন মাসে কোভিড পরিস্থিতি আগের প্রান্তিকের তুলনায় খারাপ ছিল। তাই ওই প্রান্তিকে ব্যবসায়ীদের আস্থা কমে মাত্র ৪১ শতাংশে নেমে এসেছে। আগের প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) তা ছিল প্রায় ৫৮ শতাংশ।
তাহলে কোভিডের কারণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া কেমন ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা। ৬৪ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দুর্বল। ২৭ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, মোটামুটি মানের পুনরুদ্ধার হচ্ছে। আর ৯ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে, পুনরুদ্ধারের ধরন শক্তিশালী।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি শ্লথ। কোভিড সংকট শিগগিরই শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই নতুন এই পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় করে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল ঠিক করতে হবে। ঢাকায় যে ধরনের লকডাউন প্রযোজ্য হবে, রংপুরে সে ধরনের লকডাউন প্রযোজ্য নয়। আবার তৈরি পোশাক খাতের জন্য একধরনের কৌশল লাগবে, অন্যদের ক্ষেত্রে তা হয়তো প্রযোজ্য হবে না। তাই সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কৌশল ঠিক করতে হবে।
করোনার অভিঘাত থেকে অর্থনীতি সচল রাখতে ঋণ হিসেবে কয়েক দফায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এর মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ রয়েছে।
পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রয়েছে প্যাকেজে। ব্যাংকের মাধ্যমে সহনীয় সুদে ঋণ আকারে এই প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন হারে ঋণের সুদে ভর্তুকি পরিশোধ করছে সরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ