বনের সাথে মানুষের চিরায়ত এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বিপরীতভাবে বনের সাথে মানুষের রয়েছে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক। বনকে চিরায়ত শত্রু হিসাবেই ব্যবহার করা হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে। বন সাবাড় করে মানুষের আজকের যে সভ্যতা, সেটাও দাঁড়িয়ে আছে এসব বনের কারণেই। কোনো দেশের বনকে সেদেশের হৃৎপিণ্ড বলা হয়। বাংলাদেশেও সুন্দরবন নামে একটি হৃৎপিণ্ড রয়েছে। যেটাকে ক্রমাগতভাবে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে আর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমাদেরই। সুন্দরবন রক্ষায় বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে কলমে থাকলেও বাস্তবে কার্যত হয় এর উল্টোটাই।
সুন্দরবনের চতুর্দিক থেকে গলা চেপে ধরেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বনটি দূষণ ও শিল্পকারখানার চাপে হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে লবণাক্ততার সমস্যা আগে থেকেই ছিল, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দূষণ। একদিকে চোরা শিকারিদের হাতে মারা পড়ছে জঙ্গলের বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী, অন্যদিকে থেমে নেই বনটির অভ্যন্তরে নদীর পানিতে বিষ দিয়ে মাছ নিধন। এর মধ্যে যোগ হয়েছে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।
বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সৌন্দর্য হারাচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। বিভিন্ন কারণে সংঘঠিত অগ্নিকাণ্ড ও নাশকতার আগুনে বনের গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় অনেকটা ফাঁকা অনুভব হচ্ছে সুন্দরবন। প্রাকৃতিক এ বনকে চিরচেনা রূপে ফিরতে কিংবা প্রায় ২২ বারের মতো অগ্নিকাণ্ডের ক্ষত শুকাতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। প্রাণী ও মৎস্য এবং মধুসহ বনের সম্পদ লুটতে একাধিক চক্র সক্রিয় হওয়ার কারণে বার বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে সুন্দরবনে। অভিযোগ রয়েছে, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকারের জন্য উপযোগী এলাকা তৈরির জন্য আগুন লাগানো হয়।
সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগার ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রনিত না নাশকতা তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে বন বিভাগ। গত ১৮ বছরে বনের গহীনে ২২ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটলেও বন্ধ বা প্রতিরোধ করতে পারছে না বন বিভাগ। প্রতিবার বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন ও চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ করে দেখলেও পুণরায় ঘটছে অপ্রীতিকর এমন ঘটনা। এমনকি ভবিষ্যতে আবারো সুন্দরবনে আগুন নাশকতার গন্ধ পাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
বনবিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০০২ সালে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার, একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দারবাড়িয়ায় দুই বার, ২০০৫ সালে পঁচাকোড়ালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল এলাকায় দুই বার, ২০০৬ সালে তেড়াবেকা, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পঁচাকরালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচ বার, ২০০৭ সালে পঁচাকোড়ালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়ায় তিন বার, ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১১ সালে নাংলীতে দুই বার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলী, পঁচাকোড়ালিয়া ও তুলাতলায় তিন বার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলায় একবার এবং সবশেষ চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগর এলাকায় ফের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
২২ বারের অগ্নিকান্ডে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনজ সম্পদের (সুন্দরী গাছসহ বিভিন্ন লতাগুল্ম) পুড়ে যায়; যার আর্থিক মূল্য ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৩ টাকা বলে বনবিভাগ জানিয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ সংলগ্ন লোকালয় হলো বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও মোংলা উপজেলা।
এই তিন উপজেলার বনসংলগ্ন গ্রামের মধ্যে রয়েছে ধানসাগর, জিউধরা, বৌদ্ধমারী ও কাটাখালী। এখানে কয়েক হাজার মানুষের বসবাস। এই এলাকার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ভোলা ও খড়মা নদী। নদীর ওপারেই সুন্দরবন। এখন নাব্যতা হারিয়েছে এই নদী দুটি। শীত মৌসুম এলে নদী শুকিয়ে হাঁটু পানি হয়ে যায়। ফলে বন সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করা মানুষ হেঁটে সুন্দরবনে ঢুকে পড়ে।
দিকে নানা সময়ে আগুনের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন এমন দু’জন বন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, কমিটি বনের অভ্যন্তরে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধকল্পে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি দু’ধরনের সুপারিশমালা পেশ করেছিল। সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বন-সংলগ্ন লোকালয়ের লোকজনের মাঝে আগুন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, অগ্নিকাণ্ডের পর তা নিয়ন্ত্রণ বা নেভাতে বন বিভাগের লোকবল বৃদ্ধি, বন বিভাগের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ইউনিট গঠন, বন-সংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া বিভিন্ন নদী ও খাল খননের মাধ্যমে গভীরতা সৃষ্টি প্রভৃতি।
ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, সুপারিশের অধিকাংশই দীর্ঘদিনে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে বনাঞ্চলে বারবার আগুনের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া আগুন লাগার পর তা নেভাতেও বনকর্মীদের চরম ভোগান্তি আর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিভিন্ন সময়ে বন বিভাগের গঠিত তদন্ত দল নাশকতা, অসচেতনতা, অবহেলায় ফেলে দেওয়া বিড়ি বা সিগারেটের আগুনকে এর জন্য দায়ী করেছে।
প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরে আগুনের কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ ও পরবর্তীতে এ ধরণের ঘটনা এড়াতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ রিপোর্টও পেশ করে। তবে সেসব রিপোর্টের প্রতিফলন বাস্তবে দেখা যায়না। থেকে যায় ফাইলবন্দি।
অগ্নিকাণ্ড এড়াতে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জোরালোভাবে তিনটি সুপারিশ করা হয়।
সুপারিশ তিনটি হচ্ছে- সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের সাথে মিশে যাওয়া নদী ও খাল খনন, অগ্নিকাণ্ডপ্রবণ এলাকায় প্রতি দুই কিলোমিটার পরপর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা করা, চাঁদপাই রেঞ্জের ভোলা নদীর কোল ঘেঁষে বনের পাশ দিয়ে কাঁটাতার অথবা নাইলোনের রশির নেট দিয়ে বেড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু তিনটির একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, সুন্দরবনকে আগুন থেকে রক্ষা করার জন্য লোকালয়সংলগ্ন নদী-খাল খনন ও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া খুবই জরুরি। এছাড়া বন অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধে বনরক্ষীদের তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান তিনি।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা বনজীবীদের বিড়ি সিগারেটের আগুনে অনেক সময় আগুন লাগে। এজন্য আমরা বনজীবী ও স্থানীয়দের সচেতন করেছি। সচেতনতামূলক কার্যক্রম এখনও অব্যাহত রয়েছে। তদন্ত কমিটির যে সুপারিশে যে ওয়াচ টাওয়ার করার সুপারিশ ছিল।
তিনি বলেন, বন বিভাগের একটি প্রজেক্টে ওয়াচ টাওয়ার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রজেক্টটি পাস হলে আমরা টাওয়ার করব। টাওয়ার হলে আগুনের স্থান নির্ধারণ সহজ হবে। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার ভরাট হওয়া নদী ও খাল খননের বিষয়েও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাঘ, হরিণ হত্যার পাশাপাশি খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার ও আগুন দস্যুদের হাত থেকে সুন্দরবন রক্ষায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট পেট্রোলিংসহ সব ধরনের পাহারা জোরদার করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
সুন্দরবন বহুভাবেই বিপন্ন অবস্থায় আছে এবং কমপক্ষে দুটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বড় আকারের হুমকি সৃষ্টি করেছে। সরকারের বন বিনাশী প্রকল্প, বারবার তেল ও কয়লাবাহী জাহাজডুবি, বনের ভেতর দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল এবং বন্য প্রাণী বাণিজ্যের মতো বিষয় সুন্দরবনের ক্ষতি করে আসছে। বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিকেরা বারবার সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য রক্ষায় সরকারের উদাসীনতা এমনকি সচেতন ভুল পদক্ষেপের সমালোচনা করে আসছেন। বারবার আগুন লাগার ঘটনা সার্বিকভাবে সুন্দরবনের অরক্ষিত দশার দিকেই ইঙ্গিত করছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ও প্রাণবৈচিত্র্য বাংলাদেশের অমূল্য জৈব সম্পদ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে এটা দক্ষিণাঞ্চলের পরীক্ষিত রক্ষাকবচ। সুন্দরবনকে বাঁচাতেই হবে। সুন্দরবনের আগুন–সন্ত্রাসীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষঞ্জদের মতে, দফায় দফায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সুন্দরবনের ওইসব স্থানের জীবজন্তু, পশুপাখি অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া এভাবে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে সুন্দরবন সুরক্ষা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৫১৭
আপনার মতামত জানানঃ