কবির হোসেন : বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রদের সাথে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমান্তরালভাবে চলে আসার খবর আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত। করোনা ভাইরাসের উদ্ভবের পর চীনকে বিভিন্ন অজুহাতে বিদ্ধ করার মানসে পশ্চিমাদেশগুলোর চীনকে দোষারোপ করা এই রাজনীতিরই অংশ। চীনকে আন্তর্জাতিকভাবে পরাস্ত করার জন্য করোনা ভাইরাস চীনেরই এক চক্রান্ত প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেও এখনো হাল ছাড়েনি পশ্চিমাদেশগুলো। এরই মধ্য করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি করার বিষয়টিও একইভাবে আলোচনায় চলে আসে। তবে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে সৃষ্ট রাজনীতিতেও পিছিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশ। চীন থেকে করোনা ভাইরাসের যাত্রা শুরু হলেও এর রেশ কাটিয়ে সহজেই ভ্যাকসিন রাজনীতিতে এগিয়ে আছে চীন। আন্তর্জাতিক কূটনীতিবিদরা ভ্যাকসিন নিয়ে চীনের এই রাজনৈতিক সফলতাকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সফলতা হিসাবেই দেখছেন।
ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর পিছিয়ে পড়ার পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। তারমধ্যে সর্ব প্রথম হলো— করোনা তার সবচেয়ে বড় আঘাতটি হেনেছে পশ্চিমাদেশগুলোতে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ইতালি ইত্যাদি দেশেই করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। পশ্চিমাদেশগুলো করোনার ঢেউয়ে এখনো নাকানিচুবানি খাচ্ছে। সেই হিসাবে দক্ষিণ এশিয়া থেকে করোনার যাত্রা শুরু হলেও করোনা তার বিষ দাঁতের কড়া কামড়টি বসাতে ব্যর্থ হয়েছে এই অঞ্চলে। তাছাড়া চীন থেকে ভাইরাসটির উদ্ভব যেমন হয়েছিল তেমনি করোনা থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে পেরেছে দ্রতই। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যেখানে এখনো করোনার ঢেউয়ে নাকানিচুবানি খাচ্ছে সেখানে চীন নিজেদের নিরাপদ রেখে করোনার ক্ষত থেকে দ্রুতই পরিত্রাণ লাভ করে অন্যান্য খাতগুলোতে তাদের দৃষ্টি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন গবেষনার মাধ্যমে এটাও জানা যায় যে, করোনাকালীন সময়ে বিশ্ব অর্থনীতি স্থবির থাকলেও সচল ছিল চীনের অর্থনীতি। কেবল সচলই নয়, অনেক বিশেষজ্ঞ ও গবেষনা মতে করোনাকালীন সময় চীনের অর্থনীতি অনুকূলে ছিল। ফলে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে যেমন তাদের প্রভাব আরো মজবুত করতে পেরেছে বিপরীতে পশ্চিমাদেশগুলোর প্রভাব ক্রমশ স্থিমিত হয়ে আসছে।
এছাড়া পশ্চিমাদেশগুলোর নেতৃত্বদানকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই করোনা মহামারির সময়েই কলঙ্কজনক এক ইতিহাস রচিত হয়েছে। ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প-সমর্থকদের হামলা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম এক কলঙ্ক হিসাবেই লিপিবদ্ধ থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো সামাল দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বাভাবিকভাবেই তাদের দৃষ্টি অনেকটাই সরে আসে। এই সময়ের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্ররাষ্ট্র যুক্তরাজ্যকে নতুন করোনা বা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বিপর্যস্ত করে তুললে পশ্চিমাদেশগুলোতে এক আতঙ্ক তৈরী হয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অভ্যন্তরীণ সমস্যা সামাল দিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লে এই সুযোগে চীন তাদের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নিজেদের প্রজ্ঞা ও কৌশলে শাণ দেওয়ার যথেষ্ট সময় পেয়ে যায়।
পশ্চিমাদেশগুলো করোনায় সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে নিজেদের সুস্থতার দিকেই তারা মনোনিবেশ করে বেশি। নিজেদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নয়নসহ ভ্যাকসিন সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে বেশি। ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে নিজ দেশের লোকদের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ভ্যাকসিন কেনার ঘোষণা দেয়। কেননা, ট্রাম্পের নিকট তখন নিজ দেশের আক্রান্ত লোকদের ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে ফাইজার, মডার্না ইত্যাদি কোম্পানিগুলোর সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর চুক্তি সম্পাদন হওয়ার পরেও নির্দিষ্ট সময়ে ভ্যাকসিন না পাওয়ার কারণে এক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। মোদ্দাকথা, নিজ দেশের লোকদের জন্য পশ্চিমারা ভ্যাকসিন সংগ্রহে অনেকটাই স্বার্থপরের উদাহরণ সৃষ্টি করে। অথবা পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব আক্ষেপ প্রকাশ করে কড়া সমালোচনা করেন যে, বিশ্বের ১০ ধনী রাষ্ট্র মোট ভ্যাকসিনের ৭৫ ভাগ কব্জা করে বসে আছে যেখানে বিশ্বের ১৩০টি দেশ এখনো একটিও ভ্যাকসিন পায়নি। পশ্চিমাদেশগুলোর নিজ দেশের লোকদের দিকে নজর দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে তাদের যেমন দৃষ্টি সরে আসে তেমনি এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চীন।
ভ্যাকসিন রাজনীতিতে চীনের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো ভ্যাকসিনের উৎপাদন, বিক্রয় ও বণ্টন প্রক্রিয়ার দায়িত্ব নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানির হাতে না দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখে। বিপরীতে পশ্চিমারা নিজেদের হাতে ভ্যাকসিনের নিয়ন্ত্রণ না রেখে কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়। আর স্বাভাবিকভাবে, কোনো কোম্পানিই তার উৎপাদিত পণ্য নিয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়বে না। দরদামে যেখানে বেশি দাম পাবে সেখানেই বিক্রি করতে আগ্রহী হবে। যখন সার্বিয়াতে চীনের উৎপাদিত ভ্যাকসিন ‘সিনোফার্মা’ পৌঁছায় তখন চীন সার্বিয়ায় চীনের রাষ্ট্রদূতকে তার তদারকি করার জন্য পাঠায়। বিপরীতে পশ্চিমাদেশগুলো তাদের কোম্পানিগুলোকে কোথায় এবং কী পরিমাণে ভ্যাকসিন যাচ্ছে ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। তাই যারা সর্বোচ্চ দাম দিচ্ছে তাদের কাছেই সর্বাধিক ভ্যাকসিন সরবরাহ হচ্ছে এবং সেসব হচ্ছে কেবলি উক্ত কোম্পানির নামে। পশ্চিমা দেশগুলোর এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নেই।
এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ভারতের প্রসঙ্গ আনা যেতে পারে। যুক্তরাজ্য-সুইডেনের ফর্মুলায় অক্সফোর্ডের অনুমোদিত অ্যাস্ট্রাজেনেকা উৎপাদনের অনুমোদন পায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি হলেও মোদি সরকার ভ্যাকসিনের বিক্রি কিংবা বন্টণ প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের হাতে রেখে দেয়। ফলে সেরামের ভ্যাকসিন যারাই কিনেছে কিংবা উপহার পেয়েছে তা ভারতের কাছ থেকেই পেয়েছে, কোনো কোম্পানির কাছ থেকে নয়। এতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে ভারত ও চীন দ্বৈরথের যে প্রতিযোগিতা রয়েছে, তাতে অনেকটাই এগিয়ে যায় ভারত। পশ্চিমাদের ফর্মুলা নিয়ে উৎপাদিত ভ্যাকসিন নিয়ে ভারত ভ্যাকসিন রাজনীতিতে এগিয়ে গেলেও এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পশ্চিমা দেশগুলো অনেকটাই পিছিয়ে আছে। বিপরীতে চীন নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করে বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহ অব্যাহত রাখে। কোথাও ফ্রিতে দেওয়ারও প্রক্রিয়া চালু রয়েছে তাদের। চলতি সপ্তাহে চীন ১৩টি দেশে ফ্রি ভ্যাকসিন সরবরাহের ঘোষণা দিলেও তাদের পরিকল্পনায় আরো ৩৮টি দেশ রয়েছে।
এছাড়া আফ্রিকার দেশগুলোতেও ভ্যাকসিন সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। আফ্রিকার দেশগুলোকে ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়টিকে চীন অগ্রাধিকার দিচ্ছে। চীনা সরকারের এই অঙ্গীকারের পর চীন থেকে আফ্রিকা মহাদেশে মাস্ক, করোনা পরীক্ষার কিট, চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রভৃতি সহায়তা হিসেবে সরবরাহ করতে দেখা যায়। কেবল আফ্রিকাতেই নয়, করোনার চূড়ান্ত সময়ে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের আরো অনেক দেশেই উপহার হিসাবে চীন করোনার এসব চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠায়।
চীনের আরেকটি বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল হলো, পশ্চিমাদেশগুলো ভ্যাকসিন সরবরাহে সীমাবদ্ধ থাকলেও চীন উদিয়মান বিভিন্ন দেশে উৎপাদন করে উক্ত দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়। তারা মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরো অনেক দেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদন করে সরবরাহ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। একই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে বাংলাদেশেও তাদের তদবির রয়েছে। তবে চীন এর বিপরীতে তাৎক্ষণিক কিছু পাওয়ার জন্য করছে না। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এটি লভ্যাংশ প্রদান করবে। কেননা চীন বুঝতে পেরেছে করোনা মহামারিটি আমাদের দীর্ঘ সময় বয়ে বেড়াতে হবে।
এবিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে এ পদ্ধতিতে আসার আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে, এতে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা কম হবে বটে তবে ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে এক রকম সামাজিকরণ হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমাদেশগুলো থেকে চীন বিশ্বে করোনা ভ্যাকসিন রপ্তানি করার ক্ষমতা রাখে বেশি এবং তারা সেটাই করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং টিকা নিয়ে কাজ করা দুটি আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘গাভি’ এবং ‘দ্য কোয়ালিশন ফর এন্ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন’র সমর্থনে তৈরি হয়েছে কোভ্যাক্স, যারা নিজেদের “বিশ্বের সবচে বড় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কোভিড টিকার সমাহার” বলে দাবি করে। কোভাক্সের মতো বহুপক্ষীয় স্কিমগুলো ভ্যাকসিন সহায়তায় সরবরাহকে অগ্রাধিকার দিয়েছে যা আগামী ছয় মাসের মধ্যে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-আয়ের দেশগুলির মধ্যে প্রায় ৩% সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ লোকদের সরবরাহ করা শুরু করবে। তবে কোভ্যাক্সে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো, যারা প্রথমে নিজ দেশের লোকদের গুরুত্ব দেওয়ার পর কোভ্যাক্সের মতো সংগঠনগুলোতে অনুদান নিয়ে ভাববে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো করোনা উদ্ভব নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোতে এতটাই মনোনিবেশ করেছে যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা খুব কমই ভূমিকা রাখতে পারছে। আর এরই সুযোগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। কেবল ভ্যাকসিন রাজনীতিতে নয়, যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে মহামারির বছরই ইইউ’র বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদের দেশের স্থান দখলে নিয়েছে চীন। এদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতেও চীন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে শীর্ষে পৌঁছে যাবে বলে আন্তর্জাতিক অনেক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞরাই দাবি করেছেন। তাই বলতেই হয়, বিশ্ব কি শিঘ্রই চীনের নেতৃত্ব দেখতে যাচ্ছে?
এসডব্লিউ/২৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ