দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসা অব্যাহত রয়েছে। কোথাও কোথাও মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগ আসে পুলিশের বিরুদ্ধে, কোথাওবা অস্ত্র বিক্রয়কারী হিসাবে, কোথাওবা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ, অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ, পুলিশের নেতৃত্বে মাদক পাচার চক্র গড়ে ওঠার অভিযোগ, চুরি ডাকাতি ইত্যাদি হেন কোনো অপরাধ নেই যা পুলিশ শব্দটির সাথে জুড়ে বসে নাই। তবে এসব অপরাধের একেকটার সঙ্গে একেক পুলিশের নাম এসেছে। তবে এসব অপরাধের অধিকাংশই এসআই মাসুদ রানা করে থাকেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি নিজেই গড়ে তুলেছেন অপরাধের সাম্রাজ্য। সম্প্রতি ঘুষ গ্রহণের সময় আসামির সাথে ঘুষের টাকার দর কষাকষির সময় পুলিশ কমিশনারের হাতে ধরা পড়েন তিনি। ঘটনার সত্যতা পেয়ে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এসআই মাসুদ রানা রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ । তার বিরুদ্ধে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়, মাদকসহ আসামি ধরে অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া, অবৈধ যানবাহন নিজের করে তা ফাঁড়িতে রেখে ব্যবহার করাসহ মিমাংসার নামে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে তিনি ব্যবহার করেন চোরাই প্রাইভেটকার। সর্বক্ষণ চলেন মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে। বড় বড় মাদক ব্যবসায়ী দিয়ে ব্যবসা করান। তাদের ব্যবহার করে খুচরা ব্যবসায়ীদের ধরে এনে টাকা আদায় করেন। ঠিক যেন বড় মাছ দিয়ে ছোট মাছ ধরা। এসবই এতদিন ছিল এসআই মাসুদ রানার রোজনামচা। এসআই মাসুদ রানার বিরুদ্ধে অপরাধের পাহাড় জমলেও এতদিন অধরাই থেকেছেন। গত মঙ্গলবার বিকালে পুলিশ কমিশনার অভিযোগ পেয়ে আকস্মিকভাবে নিজেই হাজির হন ফাঁড়িতে।
সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার দুপুরে জায়ফুল ইসলাম সোহেল নামরে একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হেরোইনসহ ভদ্রা জামালপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে তালাইমারী ফাঁড়ির পুলিশ। এই সোহেলের বিরুদ্ধে থানায় পূর্বের মাদকের মামলা আছে। আটকের পর আসামি সোহেলকে ফাঁড়ির এসআই মাসুদ রানার কাছে হস্তান্তর কর হয়। তবে হেরোইনসহ আটক ওই আসামির খবর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে ও মামলা না দিয়ে মাসুদ রানা গোপনে আসামিকে ছেড়ে দেয়ার জন্য দেন-দরবার শুরু করেন। তবে হেরোইনসহ আসামি আটকের এই ঘটনার খবর পেয়ে বিকেলে ফাঁড়িতে স্বশরীরে উপস্থিত হন পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক। ঠিক ওই সময় এসআই মাসুদ রানা আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য দরদামে ব্যস্ত ছিলেন। হাতেনাতে ধরে পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক তাৎক্ষণিকভাবে এসআই মাসুদ রানাকে সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দেন। মাসুদ রানা ফাঁড়ির চার্জ হারিয়ে এখন পুলিশ লাইনে।
চন্দ্রিমা থানার ওসি সিরাজুম মুনির জানান, ফাঁড়িতে পুলিশ কমিশনার আসার পর ২৫ গ্রাম হোরোইনসহ সোহেলকে গ্রেফতার দেখিয়ে মামলা দেয়া হয়েছে।
এসআই মাসুদ রানাকে সাসপেন্ড করার বিষয়টি নিশ্চিত করে ওসি জানান, কমিশনার নিজে ফাঁড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। এসআই মাসুদ রানার কর্মকাণ্ডে অনিয়ম পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন কমিশনার।
এক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে জানা যায়, আরএমপির তালাইমারী পুলিশ ফাঁড়িটি নগরীর অভিজাত এলাকা পদ্মা আবাসিকে অবস্থিত। গত দু’বছর ধরে ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে ছিলেন মাসুদ রানা। এতদিন ফাঁড়িটি ছিল মাদক ব্যবসায়ীদের মহব্বতখানা। বড় বড় মাদক ব্যবসায়ী নিয়েই কাটত মাসুদ রানার দিনরাত। অভিজাত এলাকা হওয়ায় পদ্মা আবাসিক মাদক কারবারের বড় মোকাম। এলাকায় মাদক বিক্রি ওপেন সিক্রেট। এসআই মাসুদ রানার নিয়োজিত মাদক সম্রাটরাই নিয়ন্ত্রণ করেন কারবার। দিনশেষে নোটের বান্ডিল এসে ঢুকত মাসুদ রানার পকেটে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের অভিযোগে জানা গেছে, এসআই মাসুদ রানা পদ্মা আবাসিক ও আশপাশের এলাকাকে অপরাধের অভয়ারণ্য করে তোলেন। মাসুদ মাসোহারা আদায়ের সুবিধার্থে মাদক ব্যবসায়ীদের নাম-ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়ে একটি রেজিস্টার সংরক্ষণ করতেন। এতে মাসোহারার পরিমাণ ও পরিশোধের তারিখও লিখে রাখতেন।
শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মাসে ১০ লাখ টাকা মাসোহারা পেতেন তিনি। কেউ তাকে ফাঁকি দিয়ে মাদক ব্যবসা করলে, খবর পেয়ে ধরে আনতেন ফাঁড়িতে। একবারে বকেয়াসহ পুরো মাসোহারা আদায় করে ছাড়তেন।
স্থানীয়দের অভিযোগে আরও জানা গেছে, এসআই মাসুদ রানা ও তার অনুগত কনস্টেবল জামিল প্রতিদিন ধরা-ছাড়ার বাণিজ্য করতেন। কনস্টেবল জামিলের কাছেও রয়েছে একাধিক চোরাই মোটরসাইকেল। মাদক ব্যবসায়ী কাম-সোর্সরা এসব মোটরসাইকেলে দাপিয়ে বেড়ায়।
বড় বড় এসব মাদক ব্যবসায়ী দিয়ে মাসুদ ও জামিল খুচরা কারবারিদের ধরে এনে টাকা আদায় করতেন। মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে ফাঁড়িতে মাসিক আদায় পরিস্থিতি নিয়েও সভা করতেন মাসুদ ও জামিল। এসআই মাসুদ ও কনস্টেবল জামিল তাদের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বোয়ালিয়া জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) সোনিয়া পারভীন পুরো বিষয় তদন্ত করছেন। এসি সোনিয়া জানান, তিনি তদন্তের নির্দেশ পেয়েছেন। তদন্ত শেষে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রশাসনের চোখে ফাঁকি দিয়ে এতদিন ধরে একজন এসআই নিজের অপরাধের সাম্রাজ্য পরিচালনা করছেন, বিষয়টা খুবই সন্দেহজনক। এসআই মাসুদ রানার সাথে আরো অনেকের সংশ্লিষ্ট থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দিতে চান না তারা। তারা বলেন, এই সাম্রাজ্যের ভাগ আর কোথায় কোথায় যেত তা তদন্ত করা হোক। একইসাথে এসআই মাসুদ অপরাধের পাহাড় গড়ে তুললেও তাকে সাময়িক বরখাস্ত আর পুলিশ লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মধ্য শাস্তি শেষ করে দেওয়ার সমালোচনা করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, আইনের রক্ষক হয়ে যখন একজন পুলিশ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, একজন অপরাধীর চেয়ে বেশি শাস্তি দেওয়া উচিত। অথচ আমাদের দেশে সম্পূর্ণই এর বিপরীত। অপরাধ জগতের ডন হয়েও শাস্তি পায় সাময়িক বরখাস্ত ও পুলিশ লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। মাসুদ রানা ও কনস্টেবল জামিলসহ আরো যারা জড়িত আছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০০
আপনার মতামত জানানঃ