সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার একটি নদীর তীর কেটে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ছবি তুলতে গিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি, সোমবার স্থানীয় সাংবাদিক কামাল হোসেন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসময় তার কাছ থেকে ক্যামেরা, মোবাইল ফোন এবং মোটরসাইকেল নিয়ে যান নির্যাতনকারীরা। সাংবাদিক নির্যাতনের মূল হোতা স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার ভাই ও একজন ইউপি সদস্য৷ তারা ওই এলাকায় প্রশাসনের চোখের সামনেই নদী থেকে অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
নির্যাতিত কামাল হোসেন বর্তমানে সুনামগঞ্জ জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি তাহিরপুর উপজেলা প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দৈনিক সংবাদ এবং দৈনিক শুভ প্রতিদিনের উপজেলা প্রতিনিধি।
পুলিশ, পরিবার ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যাদুকাটা নদের তীর কেটে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সংবাদের তথ্য সংগ্রহ ও ছবি নিতে সোমবার দুপুরে ওই এলাকায় যান কামাল হোসেন। গিয়ে দেখেন শ্রমিক নিয়োগ করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা পাথর ও বালু তুলছেন৷ তিনি প্রথমে পুলিশকে খবর দেন৷ পুলিশ তাকে ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেয়ার অনুরোধ করে৷ এরপর তিনি খবরের জন্য ছবি তোলেন ও ভিডিও করেন৷ তখন সেখানে কয়েকজন তাকে ধরে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করেন। সেখানে উপস্থিত এই অবৈধ ব্যবসার ‘গডফাদার’ মাহমুদ আলি সাংবাদিক কামালের কাছে গিয়ে জামার কলার ধরে তার হাতে থাকা ভোজালি দিয়ে মাথায় কোপ দিলে তিনি সরে গেলে তার কপালে লাগে৷ এতে তিনি গুরুতর আহত হন। এরপর তাকে রড দিয়ে আঘাত ও কিল ঘুষি দেয়া হয়৷ তখন তিনি জ্ঞান হারান৷ ওই সময় সেখানে ২০-৩০ জন ছিলেন৷ ওই ব্যক্তিরা পরে তাকে ধরে নিয়ে যান পাশের চকবাজারে। সেখানে একটি গাছের সঙ্গে রশি দিয়ে তাঁকে বেঁধে রাখা হয়।
খবর পেয়ে বেলা আড়াইটার দিকে স্থানীয় আরেক সাংবাদিক ও কামাল হোসেনের পরিবারের লোকজন এলাকার বাদাঘাট ফাঁড়ি থেকে পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। পরে তাঁকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
কামাল জানান, যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি দেখি আমাকে হাত-পা বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ পাশের বাদাঘাট চকবাজারে নিয়ে গিয়ে গাছের সাথে বাঁধা হয়৷ আমি প্রতিবাদ করলে তারা আবারো মারপিট করে৷ আহত সাংবাদিক কামাল অভিযোগ করেন, তার ওপর হামলার মূল পরিকল্পনাকারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোশাররফ তালুকদারের ভাই মুশাহিদ তালুকদার ও স্থানীয় ইউপি মেম্বার মনির উদ্দিন৷ তারাও ঘটনাস্থলে ছিলেন৷ তাদের নির্দেশেই হামলা হয়েছে৷ তারা অনেক দিন ধরেই অবৈধভাবে পাথর ও বালু তোলার সঙ্গে জড়িত৷ তাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে৷ বাধ কাটার মামলাও আছে৷ প্রতি বছরই তাদের এই অবৈধ কাজ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট হয়, কিন্তু কোনো কাজ হয় না৷
এদিকে ২ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় কামাল হোসেনকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতনের প্রতিবাদে, মানববন্ধন করেছে সুনামগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটি। মঙ্গলবার সকালে শহরের আলফাত উদ্দিন স্কয়ারে আয়োজিত মানববন্ধনে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিক নেতারা বলেন, যাদুকাটা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সময়, স্থানীয় সাংবাদিক কামাল হোসেন ছবি তুলতে গেলে, ঐ চক্রটি তাকে গাছের সাথে বেঁধে নির্মম নির্যাতন করে। এ ঘটনায় জড়িতদের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে গ্রেপ্তার কোরে, কঠোর শাস্তির দাবী জানান তারা।
এই ঘটনায় মোট পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে৷ আসামিরা হলেন, মাহমুদ আলী শাহ, রইস উদ্দিন, দীন ইসলাম, মুশাহিদ তালুকদার ও মনির উদ্দিন মেম্বার৷ পুলিশ সন্দেহজনকভাবে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে৷ তবে এজাহারভুক্ত কাউকেই এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ থানার সাব-ইন্সপেক্টর দীপঙ্কর বিশ্বাস জানান, এজাহারভুক্তরা পলাতক আছে৷ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷
তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোশাররফ তালুকদার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা ভাই মুশাহিদ ঘটনার সময় সেখানে ছিলোনা৷ আর মনির মেম্বার অনেক জনপ্রিয়৷ সে তিন বারের মেম্বার তবে তিনি বলেন, তারা পাঁচ ভাই৷ মুশাহিদ সবার ছোট৷ সবাই প্রাপ্ত বয়স্ক৷ যার যার ব্যবসা স্বাধীনভাবে করে৷ সে কি করে সব সে জানেনা৷ এলাকার অনেকেই গোপনে এবং রাতে পাথর ও বালু তোলে৷ তিনি নিজে পাথরের ব্যবসা করেন৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মফস্বলের প্রত্যেকটা সাংবাদিক পরিচিত। সবাই সবাইকে চেনে। ওখানে কোন সংবাদ হলে তাকে টার্গেট করা সহজ। ঢাকায় সেটা সম্ভব না। মফস্বলের সাংবাদিক প্রতি মুহুর্তে, প্রতিদিনই ঝুঁকির মধ্যে থাকে।মফস্বল সাংবাদিকদের কোনো ধরনেরই নিরাপত্তা নাই৷ আর্থিক বা শারীরিক কেনোটাই না৷ অধিকাংশ সাংবাদিক বেতন পান না আবার প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও দুর্বৃত্তদের চাপের মুখে থাকতে হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/২৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ