রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল প্রকল্প। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ঈশ্বরদীতে এই কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে, রাশিয়ার সহায়তায়। এখন এটি বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়ার অপেক্ষায়। সরকার আশা করছে, এটি চালু হলে দেশের বিদ্যুৎ সংকট অনেকটাই দূর হবে। কিন্তু প্রকল্পটি পুরোপুরি প্রস্তুত নয়—এমন ইঙ্গিত দিয়েছে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ। সম্প্রতি তারা জানিয়েছে, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে এখনো বেশ কিছু নিরাপত্তা ত্রুটি রয়ে গেছে, যা দ্রুত সমাধান না করলে এটি ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
গত ১০ থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করেছে আইএইএ’র ১৪ জনের একটি বিশেষজ্ঞ দল। এই দলে বুলগেরিয়া, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেনসহ ৮টি দেশের পারমাণবিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তারা কেন্দ্রের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন এবং কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে তারা একটি টেকনিক্যাল রিপোর্ট প্রকাশ করেন, যেখানে মোট ১৭টি নিরাপত্তা ইস্যু চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি সরাসরি সুপারিশ এবং ৪টি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞ দলটি জানিয়েছে, এই ত্রুটিগুলো সমাধান না করা হলে কেন্দ্রের নিরাপদ অপারেশন বা পরিচালনা ব্যাহত হতে পারে।
রিপোর্টে বলা হয়, রূপপুর প্রকল্পে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। আগুন লাগলে দ্রুত প্রতিরোধের জন্য যে ধরনের যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি প্রয়োজন, সেগুলো পুরোপুরি কার্যকর নয়। ফলে জরুরি অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হতে পারে। তাছাড়া কেন্দ্রের অপারেশনাল মান, কর্মীদের দায়িত্ব তদারকি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাও এখনও আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছায়নি। এই ধরনের ত্রুটি থাকলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়, বিশেষ করে এমন একটি প্রকল্পে যেখানে তেজস্ক্রিয় পদার্থের ব্যবহার রয়েছে।
এ ছাড়া কমিশনিংয়ের সময় অর্থাৎ চালু করার আগের প্রস্তুতি পর্যায়ে যন্ত্রপাতি সংরক্ষণের দিকেও নজর দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে দলটি। অনেক যন্ত্রাংশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হয়ে যেতে পারে যদি সেগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা হয়। এতে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা দেখা দিতে পারে বা কেন্দ্রের চুল্লির নিরাপত্তামূলক কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। এই বিষয়গুলো আইএইএ খুব গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছে।
বিশেষজ্ঞ দলটি মোট ১১টি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র পর্যালোচনা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, অপারেশন, রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ, জরুরি প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা। তাদের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা ৩৯৬ বছরের সমান—অর্থাৎ এরা দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পারমাণবিক প্রকল্পে কাজ করেছেন। তাই তাদের এই পর্যালোচনা বাংলাদেশ সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে সব দিকই নেতিবাচক নয়। রিপোর্টে প্রশংসাও এসেছে কিছু বিষয়ে। রূপপুর ট্রেনিং সেন্টারে স্থাপিত অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ সিমুলেটরের কথা উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি ব্যবহার করে কর্মীরা রিফুয়েলিং মেশিন চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। আইএইএ দলটি মনে করে, এটি ভবিষ্যতে নিরাপদ অপারেশন নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন এবং রূপপুর প্রকল্পের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আইএইএ’র চিহ্নিত সমস্যাগুলো তারা গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু সংশোধনমূলক পদক্ষেপও শুরু হয়েছে। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আগামী এক বছরের মধ্যে বেশিরভাগ ত্রুটি কাটিয়ে তোলা হবে। এ ছাড়া আগামী ১৮ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে আইএইএ’র দল আবার এসে ফলোআপ পরিদর্শন করবে। তখন দেখা হবে, তাদের দেওয়া সুপারিশগুলো কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দুইটি ইউনিটে মিলিয়ে এটি প্রায় ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। প্রথম ইউনিটে জ্বালানি লোডিং শুরু হওয়ার কথা চলতি বছরের শেষ দিকে। দ্বিতীয় ইউনিট চালু হবে ২০২৬ সালের দিকে। কিন্তু তার আগে যদি নিরাপত্তা ঘাটতি পুরোপুরি দূর না করা যায়, তাহলে বড় ধরনের ঝুঁকি থেকে যাবে—এই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পারমাণবিক প্রকল্পে সামান্য ত্রুটিও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ইতিহাসে চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতো দুর্ঘটনার উদাহরণ আছে। যদিও রূপপুরে এমন বিপদের আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম, তবুও সতর্ক থাকা জরুরি। কারণ, একটি ছোট ভুল পুরো অঞ্চলকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। বাংলাদেশে এমন প্রকল্প প্রথমবারের মতো হওয়ায় এখানে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞ জনবল এখনো গড়ে ওঠেনি। তাই প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা সংস্কৃতি জোরদার করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
অন্যদিকে, অনেকেই মনে করেন এই প্রকল্প শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নয়, এটি বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতারও প্রতীক। রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত হলেও বাংলাদেশের প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাদের জন্য এটি শেখার একটি বড় সুযোগ। ভবিষ্যতে যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে, তাহলে বাংলাদেশ নিজস্ব পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম হবে।
রূপপুর প্রকল্প নিয়ে শুরু থেকেই নানা বিতর্ক রয়েছে—ব্যয়, সময়, স্বচ্ছতা, এবং পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে। এখন নতুন করে নিরাপত্তা প্রশ্ন যুক্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বেড়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বস্ত করা হচ্ছে যে, সব নিরাপত্তা মান আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী নিশ্চিত করা হবে। প্রকল্পের কর্মকর্তা ও রুশ বিশেষজ্ঞরা একসঙ্গে কাজ করছেন যাতে কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা না থাকে।
অন্যদিকে, আইএইএ’র রিপোর্ট প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক মহলেও বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কারণ, এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত। পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো সবসময়ই একটি আঞ্চলিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই প্রতিবেশী দেশগুলোও রূপপুরের নিরাপত্তা মান নিয়ে আগ্রহী।
সবশেষে বলা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য যেমন গর্বের, তেমনি এটি এক বিশাল দায়িত্বও। নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি আইএইএ’র সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে রূপপুর সত্যিই বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে এক নতুন যুগের সূচনা করবে। কিন্তু যদি অবহেলা করা হয়, তাহলে এই স্বপ্নের প্রকল্প উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো—ত্রুটি স্বীকার করা, তা সমাধান করা, এবং আন্তর্জাতিক মানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এভাবেই রূপপুর প্রকল্পকে দেশের উন্নয়নের আশীর্বাদে পরিণত করা সম্ভব হবে।
আপনার মতামত জানানঃ