মানুষ আসলে কখনো স্থির হয়নি, বরং সে এক অবিরাম যাত্রার ফল। কয়েক মিলিয়ন বছর আগে যখন আমাদের পূর্বপুরুষরা আফ্রিকার বনে ঘুরে বেড়ানো এক ধরণের প্রাইমেট ছিল, তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে একদিন তারা দাঁড়িয়ে হাঁটবে, আগুন আবিষ্কার করবে, ভাষা সৃষ্টি করবে, সভ্যতা গড়ে তুলবে। আজকের আধুনিক মানুষ—হোমো স্যাপিয়েন্স—হচ্ছে সেই দীর্ঘ বিবর্তনের সাফল্য। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়: আমরা কি এখন শেষ বিন্দুতে এসে পৌঁছেছি? নাকি মানুষ এখনো বদলাচ্ছে, আর ভবিষ্যতে হয়তো একেবারেই অন্যরকম হয়ে উঠবে?
এই প্রশ্ন নতুন নয়। বিজ্ঞানের আলোচনায়, দর্শনের বিতর্কে এবং এমনকি সাহিত্যের কল্পনায়ও মানুষ সবসময় ভেবেছে তার ভবিষ্যৎ রূপ নিয়ে। বিবর্তন কি থেমে গেছে? মানুষ কি আর বদলাবে না? নাকি আজকের প্রযুক্তি, সমাজ এবং পরিবেশ তাকে এমনভাবে রূপান্তরিত করবে, যা আমরা এখন কল্পনাও করতে পারি না?
মানুষের বিবর্তনের কাহিনি হলো টিকে থাকার কাহিনি। প্রকৃতির প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মানুষকে একটু একটু করে বদলাতে বাধ্য করেছে। কখনো সেটা ছিল খাদ্যের অভাব, কখনো শিকারির হুমকি, কখনো আবার প্রতিকূল আবহাওয়া। লাখো বছর ধরে এসব চাপে টিকে থাকার জন্য মানুষের শরীরে, মস্তিষ্কে আর জিনে ঘটেছে অসংখ্য পরিবর্তন। এই প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানীরা বলেন প্রাকৃতিক নির্বাচন। যে বৈশিষ্ট্য বেঁচে থাকার জন্য ভালো, সেটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে টিকে গেছে।
আজকের যুগে এসে দৃশ্যপট অনেকটা বদলে গেছে। এখন আর মানুষকে প্রতিদিন বাঘের ভয় পেতে হয় না, কিংবা খাবারের জন্য শিকার করতে হয় না। আধুনিক চিকিৎসা, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি মানুষের টিকে থাকার লড়াই অনেক সহজ করেছে। ফলে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে—তাহলে কি বিবর্তনের আর কোনো প্রয়োজন নেই? কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিবর্তন থেমে নেই। এটি ধীরে ধীরে এখনো চলছে, শুধু তার রূপ পাল্টেছে।
বিবর্তনের সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ বিজ্ঞানীরা তুলে ধরেছেন। যেমন, হাজার বছর আগে বেশিরভাগ মানুষ দুধ হজম করতে পারত না। কিন্তু কৃষি সমাজ গড়ে ওঠার পর যখন মানুষ গরুর দুধ খাওয়া শুরু করল, তখন ধীরে ধীরে কিছু মানুষের জিনে এমন পরিবর্তন হলো যে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও ল্যাকটোজ হজম করতে পারল। আজ ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক জনগোষ্ঠীতে এই বৈশিষ্ট্য ছড়িয়ে গেছে। আবার, ম্যালেরিয়া-প্রবণ অঞ্চলে দেখা গেছে কিছু মানুষের জিন এমনভাবে বদলেছে যে তারা আংশিক সুরক্ষা পেয়েছে। এর ফলে সেই বৈশিষ্ট্য প্রজন্মের পর প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে।
এগুলো ছোট পরিবর্তনের উদাহরণ হলেও এগুলো প্রমাণ করে বিবর্তন এখনো সক্রিয়। মানুষের শরীর, প্রতিরোধ ক্ষমতা, এমনকি মানসিক বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হচ্ছে।
কিন্তু আজকের বিবর্তন শুধু প্রকৃতির চাপে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষের তৈরি সমাজ ও প্রযুক্তি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। নগরজীবন, বায়ুদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃত্রিম আলো, নিরবচ্ছিন্ন স্ক্রিন ব্যবহার—এসবই আমাদের শরীরকে নতুনভাবে প্রভাবিত করছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসবের প্রভাব হয়তো ভবিষ্যতের প্রজন্মের জিনে প্রতিফলিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, শহরে বসবাস করা মানুষদের দেহ হয়তো ধীরে ধীরে দূষণ সহ্য করার ক্ষমতা তৈরি করবে। কিংবা নতুন ভাইরাসের মোকাবেলায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পাল্টে যাবে।
প্রযুক্তির উন্নতি বিবর্তনের পথে একেবারেই নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আগে বিবর্তন হতো শুধু প্রকৃতির হাতে। এখন মানুষ নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে চাইছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে মানুষের ডিএনএ সম্পাদনা করা সম্ভব হচ্ছে। তাতে জন্মের আগেই নির্দিষ্ট রোগ মুছে ফেলা যেতে পারে। আবার কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা বায়োনিক প্রযুক্তি মানুষের শরীরকে নতুনভাবে শক্তিশালী করছে।
এই কারণে অনেকেই বলেন, ভবিষ্যতে মানুষ হবে এক ধরণের “হাইব্রিড”—আধা প্রাকৃতিক, আধা প্রযুক্তিগত। আমরা হয়তো এমন এক প্রজাতিতে পরিণত হবো, যেখানে মস্তিষ্কের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সরাসরি সংযোগ থাকবে। মানুষের স্মৃতিশক্তি, শেখার ক্ষমতা, এমনকি আবেগকেও প্রযুক্তি প্রভাবিত করবে।
মহাকাশ অভিযানের কথাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বাইরের পরিবেশে দীর্ঘ সময় কাটালে শরীর বাধ্য হয়ে বদলাবে। শূন্য মাধ্যাকর্ষণ, বিকিরণ, সীমিত খাদ্য—এসবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে মানুষের হাড়, পেশী, এমনকি চোখের গঠনও পাল্টে যেতে পারে। একদিন যদি মানুষ মঙ্গল গ্রহে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে, তবে তাদের শরীর নিশ্চয়ই পৃথিবীর মানুষের চেয়ে আলাদা হয়ে উঠবে।
তবে সব পরিবর্তন যে ইতিবাচক হবে তা নয়। অনেক সময় অপ্রত্যাশিত দিকেও বিবর্তন এগোতে পারে। যেমন, প্রযুক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা হয়তো শরীরকে দুর্বল করে দিতে পারে। অনেকে বলেন, যন্ত্রের কারণে মানুষের শারীরিক পরিশ্রম কমে যাচ্ছে, ফলে ভবিষ্যতের মানুষ হয়তো শক্তিশালী দেহের বদলে দুর্বল দেহের অধিকারী হবে। আবার মানসিক চাপ, একাকিত্ব আর প্রযুক্তি-নির্ভর জীবনের কারণে মানুষের মানসিক গঠনও পাল্টে যেতে পারে।
বিবর্তনের ভবিষ্যৎ পথ তাই অনেকটাই অনিশ্চিত। বিজ্ঞানীরা নানা পূর্বাভাস দেন, কেউ বলেন মানুষ আরও বুদ্ধিমান হবে, কেউ বলেন মানুষ ছোট আকারের হয়ে যাবে, কেউ আবার আশঙ্কা করেন প্রযুক্তির প্রভাবে মানুষ নিজেই নিজের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারাবে। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত—বিবর্তন থেমে নেই।
মানুষ সবসময় প্রশ্ন করেছে—আমি কে, আমি কোথা থেকে এসেছি, আমি কোথায় যাবো। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞান দেখিয়েছে, আমরা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের এক দীর্ঘ যাত্রার ফল। আজও সেই যাত্রা চলছে। শুধু আমাদের গন্তব্যটা এখন আর একমাত্র প্রকৃতি ঠিক করছে না, আমরা নিজেরাও সক্রিয় অংশ নিচ্ছি।
ফলে বলা যায়, মানুষ ভবিষ্যতে কেমন হবে তা নির্ভর করছে পরিবেশ, প্রযুক্তি আর আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তের উপর। আমরা চাইলে হয়তো রোগমুক্ত, শক্তিশালী, বুদ্ধিমান মানুষ তৈরি করতে পারব। আবার অসচেতন হলে হয়তো প্রযুক্তির বন্দি হয়ে পড়ব। যেভাবেই হোক, মানুষ বদলাবে—কারণ বিবর্তন হলো এক অবিরাম নদী, যার স্রোত কখনো ধীর, কখনো দ্রুত, কিন্তু কখনোই থেমে থাকে না।
আপনার মতামত জানানঃ