ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে প্রাচীন নগরী হিপ্পোসে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সম্প্রতি এমন এক আবিষ্কার করেছেন, যা শুধু ইতিহাসবিদদের নয়, সামাজিক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ইতিহাসের গবেষকদেরও চমকে দিয়েছে। খননের সময় আবিষ্কৃত একটি বিরল মোজাইককে গবেষকেরা প্রাচীন বিশ্বের প্রথম দিকের একটি প্রবীণ নিবাস বা বৃদ্ধাশ্রমের চিহ্ন হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। প্রায় ১৬০০ বছর আগের বাইজেন্টাইন যুগের এই নিদর্শন প্রমাণ করছে, সমাজে বয়স্কদের যত্ন নেওয়ার সংগঠিত ব্যবস্থা তখনই শুরু হয়েছিল।
হিপ্পোস নগরী ছিল প্রাচীন ডেকাপোলিস অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শহর। গ্যালিলি সাগরের পূর্বদিকে পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত এই নগরী খ্রিষ্টীয় সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। বাইজেন্টাইন যুগে এটি শুধু ধর্মীয় কার্যক্রমের কেন্দ্রই নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এক সক্রিয় নগরী ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে মোজাইকটির আবিষ্কার এই ধারণা দেয় যে, খ্রিষ্টান সমাজ শুধু ধর্মীয় উপাসনা নয়, বরং সামাজিক দায়িত্ববোধ ও প্রবীণদের যত্নের দিকেও গুরুত্ব দিত।
মোজাইকটিতে গ্রিক ভাষায় তিন লাইনের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে, যার অর্থ দাঁড়ায়—“প্রবীণদের শান্তি কামনা করি।” এটি খোদাই করা হয়েছে একটি ক্রুশচিহ্নের ওপর। পাশাপাশি দেখা যায় খ্রিষ্টীয় প্রতীক আলফা ও ওমেগা, ময়ূর, পানপাত্র থেকে জলপানরত পাখি, সাইট্রাস ও সাইপ্রাস গাছের নকশা। এসব প্রতীক বাইজেন্টাইন যুগের ধর্মীয় শৈল্পিক ধারা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটালেও শিলালিপির বার্তা গবেষকদের অন্য এক ব্যাখ্যার দিকে নিয়ে যায়।
প্রথমদিকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ভেবেছিলেন, এটি হয়তো কোনো গির্জার অংশ। কারণ ক্রুশচিহ্ন ও আলফা-ওমেগার মতো প্রতীকগুলো সাধারণত গির্জা বা মঠেই দেখা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, হিপ্পোসে ইতিমধ্যেই একাধিক গির্জার ধ্বংসাবশেষ খনন করে পাওয়া গেছে। স্থাপত্যগত প্রমাণও মিলছিল না। তাই গবেষকরা নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেন। তখনই শিলালিপি এবং অবস্থানগত দিক বিশ্লেষণ করে প্রবীণ নিবাস বা বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা সামনে আসে।
বিশ্ববিদ্যালয় অব হাইফার জিনম্যান ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজির নেতৃত্বে ২০২৩-২৪ সালে চালানো খননে মোজাইকটির একটি খণ্ড উদ্ধার হয়। ধ্বংসাবশেষের স্তূপের নিচে এটি পাওয়া যায়, যার সঙ্গে মৃৎপাত্রের টুকরো, ভাঙা মোজাইক এবং অসম্পূর্ণ শিলালিপিও আবিষ্কৃত হয়েছে। মেঝের নিচ থেকে পাওয়া কয়েনগুলোর তারিখ নির্ধারণ করে গবেষকরা দেখেছেন, এগুলো চতুর্থ শতাব্দীর শেষ থেকে পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর সময়ের। ফলে মোজাইকটির বয়স প্রায় ১৬০০ বছর বলে ধরা হচ্ছে।
গবেষক দলটি গ্রিক ভাষার শিলালিপি বিশ্লেষণ করে দেখতে পান, এটি কেবল ধর্মীয় উপাসনার জন্য নয়, বরং প্রবীণদের শান্তি, নিরাপত্তা ও যত্নের বার্তা বহন করছে। জেরুজালেমে পাওয়া এক প্রাচীন শিলালিপিতে বাইজেন্টিয়াম থেকে আগত এক দাতা দম্পতির উল্লেখ আছে, যারা একটি গির্জার সঙ্গে প্রবীণ নারীদের জন্য নিবাস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই আবিষ্কারটির সঙ্গে হিপ্পোসে পাওয়া মোজাইকটির সাদৃশ্য গবেষকদের আরও দৃঢ় করেছে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামের বাইজেন্টাইন শিল্পের অধ্যাপক এমেরিটা লেসলি ব্রুবেকার একে “চমকপ্রদ” আবিষ্কার বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, সেই সময়ের হাসপাতালগুলোতে প্রবীণদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকলেও, কোনো নির্দিষ্ট নিবাসের প্রমাণ এতদিন হাতে আসেনি। তাই এটি প্রাচীন বৃদ্ধাশ্রমের প্রথম চিহ্ন হতে পারে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক পণ্ডিত ড্যানিয়েল রেনল্ডস বলেছেন, প্রতীকের ধরন দেখে এটি একটি গির্জা বা মঠ হতে পারে, তবে এর ভেতরে প্রবীণদের যত্ন নেওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল বলেই ধারণা করা যায়।
খনন প্রকল্পের সহপরিচালক প্রত্নতত্ত্ববিদ মাইকেল আইজেনবার্গ বলেছেন, এই আবিষ্কারের ফলে নতুন অনেক প্রশ্ন সামনে এসেছে। এটি কি সত্যিই আলাদা একটি প্রবীণ নিবাস ছিল, নাকি একটি বৃহৎ মঠ বা হাসপাতালের অংশ? ক্রুশ, আলফা-ওমেগা, ময়ূর এবং পানপাত্রের প্রতীক কি শুধুই ধর্মীয় অর্থ বহন করে, নাকি তার সঙ্গে সামাজিক কল্যাণের দিকও জড়িয়ে ছিল?
হিপ্পোস শহর বাইজেন্টাইন যুগে শুধু ধর্মীয় কেন্দ্রই নয়, বরং কৃষি, বাণিজ্য ও সামাজিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ফলে প্রবীণদের জন্য আলাদা নিবাস বা যত্নকেন্দ্র গড়ে তোলার মতো সংগঠিত প্রচেষ্টা এখানে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আধুনিক যুগে যেমন বৃদ্ধাশ্রম পরিবার থেকে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান, তেমনি বাইজেন্টাইন যুগেও পরিবার ছাড়াও ধর্মীয় গোষ্ঠী বা মঠের মধ্যে প্রবীণদের যত্নের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল—এমন ধারণাই এই আবিষ্কারকে ঘিরে তৈরি হয়েছে।
২০০০ সাল থেকে নিয়মিত খননকাজ চলছে হিপ্পোসে। ইতিমধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিকরা রোমান যুগের ব্যাসিলিকা, থিয়েটার, স্নানাগার, নগর ফটক ও স্বর্ণালংকার উদ্ধার করেছেন। কিন্তু এবার পাওয়া মোজাইকটি শুধু স্থাপত্যশিল্প বা ধর্মীয় ইতিহাস নয়, বরং সামাজিক ইতিহাসেরও একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিল।
প্রবীণদের যত্ন নেওয়ার প্রতিষ্ঠান ১৬০০ বছর আগেই গড়ে উঠেছিল—এই আবিষ্কার আমাদের সামনে এক মৌলিক সত্য হাজির করছে। আজকের সমাজে যেখানে বৃদ্ধাশ্রম একটি আলোচিত বিষয়, সেখানে বাইজেন্টাইন যুগে তার শিকড় থাকার প্রমাণ মানবসভ্যতার সামাজিক বিকাশের ধারাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করবে।
আপনার মতামত জানানঃ