টাঙ্গাইলের শাল, সেগুন ও গজারির বন দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বন হিসাবে পরিচিত। ভূমিহীন, দুস্থ নারী, অনগ্রসর গোষ্ঠী, দরিদ্র আদিবাসী ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের এসব প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও অপ্রাপ্তবয়স্ক, সরকারি কর্মকর্তা ও কোটিপতি ও প্রভাবশালীদের নামে বরাদ্দ চলছে। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছে এক শ্রেণির অসাধু বন কর্মকর্তা যারা আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে প্রভাবশালীদের প্লট বরাদ্দে সহযোগিতা করে থাকেন। এমনকি নিয়ম লঙ্ঘন করে নিজেদের প্লট বাগিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
বনের কাঠ চুরি বন্ধে এবং বনজ সম্পদ রক্ষার জন্য সরকার ভূমিহীন, দরিদ্র, বিধবা ও দুর্দশাগ্রস্ত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার লক্ষ্যে ২০০৪ সালে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে স্থানীয়দের মধ্যে সামাজিক বনায়নের প্লটের তেমন কোন চাহিদা না থাকলেও সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্থানীয়রা লাভবান হওয়ায় প্লটের চাহিদা বেড়ে যায়। এই সুযোগে অসাধু বন কর্মকর্তারা সামাজিক বনায়নের প্লট বরাদ্দে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দাবি করে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। ফলে প্রকৃত ভূমিহীন, দরিদ্র, বিধবা ও দুর্দশাগ্রস্তরা টাকার অভাবে এই প্লট নিতে পারছে না। স্থানীয় প্রভাবশালীরা অসাধু বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে একাধিক প্লট নিচ্ছে। এতে সরকারের মূল লক্ষ্যই ভেস্তে যেতে বসেছে।
স্থানীয়রা জানান, যাদের টাকা আছে তারা প্লট নিয়েছে। ১০-১৫ হাজার করে টাকা দিতে পারিনি প্লটও পায়নি। যারা মাতব্বর তারা ৮-১০টা প্লট নিয়েছে। গরীব মানুষরা এলাকায় প্লট পায়নি।
ধলাপাড়া রেঞ্জের আওতায় বিট অফিস রয়েছে ৬টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সৃজন করা ঝড়কা বিটের বাগানে তালিকায় ২১৯ নম্বরে উপকারভোগী হিসেবে নাম রয়েছে মো. সবুর উদ্দিনের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি সোনালী ব্যাংকের জিএম পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন।
একই তালিকায় ২২০ নম্বরে নাম রয়েছে সবুর উদ্দিনের স্ত্রী খন্দকার সামসুন নাহারের। তিনি তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। দু’জনেই থাকেন ঢাকায়।
তালিকায় ১৯৭ নম্বরে নাম আছে আনোয়ার হোসেনের। জানা যায়, তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার। এ ছাড়া তালিকায় ১৯৮ রোজিনা ও ১৭৬ নম্বরে নাম আছে জাহিদুল ইসলামের। তাদের বাড়ি মধুপুর ও কালিহাতী উপজেলায়। বড় বড় ব্যবসায়ী থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তি কেউ বাদ যায়নি প্লট প্রাপ্তির তালিকায়।
২০১০ সালের ১১ জানুয়ারি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০০৪ সালে করা সামাজিক বনায়নের বিধিমালা সংশোধন করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেখানে বিধি ৬ এর (খ) উপ-বিধিতে বলা আছে, সাধারণভাবে কোনো সামাজিক বনায়ন এলাকার এক বর্গকিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্য থেকে ওই এলাকার উপকারভোগী নির্বাচিত হবেন। যে শ্রেণির লোক নির্বাচিত হবেন তারা হলেন- ভূমিহীন, ৫০ শতাংশের কম ভূমির মালিক, দুস্থ নারী, অনগ্রসর গোষ্ঠী, দরিদ্র আদিবাসী, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা অথবা মুক্তিযোদ্ধার অসচ্ছল সন্তান। কিন্তু ঘাটাইলে সে তালিকায় কিছুসংখ্যক প্লট ওই শ্রেণির লোক বরাদ্দ পেলেও বেশিরভাগই পেয়েছেন ধনাঢ্যরা। আর তাদের এসব প্লট বরাদ্দের পিছনে কাজ করেছেন বন বিভাগরই কিছু কর্মকর্তা।
গত দুই বছর আগে প্লট বরাদ্দের নামে অর্থ নেয়া ও সামাজিক বনায়নের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বন বিভাগের দুই কর্মকর্তাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে বন সৃজনের কাজে ব্যবহার না করে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ এবং সামাজিক বনায়নের প্লট বরাদ্দের নামে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়াও দুদক সামাজিক বনায়নের টাকা আত্মসাৎ ও বরাদ্দের নামে দুর্নীতির অভিযোগে আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দুদকের মামলায় দমানো যায়নি তাদের। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বন কর্মকর্তাদের অসাধু শ্রেণি প্রভাবশালী থেকে শুরু করে ধনী কোটিপতিদের প্লট বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ উঠছে তাদের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যারা বরাদ্দ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করছে তাদেরই পুনরায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছে আর্থিক সুবিধা গ্রহণকারী অসাধু বনকর্মকর্তারা। তারা মনে করেন, আইনের মধ্যে থেকেই প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও নিয়মবহির্ভূত কাউকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলেও এবিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। আর এরই সুযোগ গ্রহণ করে অসাধু বন কর্মকর্তাদের মদদে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্লট বাগিয়ে নিচ্ছে বিত্তশালীরা। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এবিষয়ে সরকারের প্রত্যক্ষ নজরদারির অভাবে এমন অনিয়ম নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদন্তসহ দোষীদের শাস্তি দাবি করে আহ্বান করেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৭
আপনার মতামত জানানঃ