বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক মব ভায়োলেন্স বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলার ঘটনায় জনমনে নতুন এক আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ১৪১টি মব ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে এবং তাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৮৩ জন। আর পুরো অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৪ জনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, এবং সংগঠিত দলীয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব এই প্রবণতাকে আরও গভীর করে তুলছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—এই তিনটি দল মব ভায়োলেন্সের রাজনীতিকে কার্যকর কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে। যদিও দলগুলো এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে, তথাপি মাঠ পর্যায়ে তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বারবার মব সৃষ্টির অভিযোগ উঠছে। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে এনসিপি, যাদের নাম এসেছে অন্তত কয়েক ডজন ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে।
চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের নেতৃত্বে সংঘটিত এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একজন পুলিশ কর্মকর্তার অপসারণ—এই ঘটনা পুরো দেশকে হতবাক করে দেয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এটিই ছিল স্পষ্ট উদাহরণ যে, সংগঠিত মব কীভাবে প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত আদায় করে নিচ্ছে।
বিএনপি ও জামায়াতের ক্ষেত্রেও এমন অনেক ঘটনা আলোচিত হয়েছে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে জুতার মালা পরানো ও অপদস্থ করা, ঢাকার মহাখালীতে এক নারীকে মারধর—এসব ঘটনায় বিএনপি এবং তাদের অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। যদিও এসব ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি বা বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত দলটি নিয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মব তৈরির অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা মব অভিযোগ সেই প্রেক্ষিতে আলোচিত। তবে জামায়াতও এ ধরনের অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ‘মব রাজনীতি’ আসলে রাজনৈতিক দলের ছদ্মাবরণে একটি নতুন কৌশল। এতে দলগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে—জনতার ‘ক্ষোভ’ বা ‘বিক্ষোভ’কে পুঁজি করে রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা এবং নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে দৃঢ় করা। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সময়ে এই কৌশল আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা মব ঘটনার পক্ষে নয়, বরং জনগণের মধ্যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে। তবে তারা যখন এসব ঘটনার ব্যাখ্যায় ‘জনরোষ’, ‘ক্ষুব্ধ জনতা’ বা ‘প্রেসার গ্রুপ’ শব্দ ব্যবহার করে, তখন এটিকে পরোক্ষভাবে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা বলেই মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
মজার বিষয় হলো, দলগুলো মুখে মবের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কথা বললেও, বাস্তবে তারা মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিনের দমন-পীড়নের শিকার হওয়া নেতাকর্মীরা এখন নিজেদের ক্ষোভ ও প্রতিশোধ পরায়ণ মানসিকতা থেকে দলবদ্ধ হামলার মতো পথ বেছে নিচ্ছে। আর রাজনৈতিক দলগুলো এটাকে থামানোর বদলে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে।
অন্যদিকে সরকারও মব ভায়োলেন্স দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না—এমন অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে গত ফেব্রুয়ারিতে ‘বুলডোজার মিছিলের’ ঘটনায় প্রশাসনের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যেহেতু এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি, তাই অনেকের মনে হয়েছে এতে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসায় হয়তো সরকারও পরিস্থিতি নিয়ে কৌশলী আচরণ করছে।
কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স যেমনটি বলেছেন, “সরকার না চাইলে মবের ঘটনা ঘটতে পারে না।” তিনি আরও বলেন, “রিজিম পরিবর্তনের পর যার যার স্বার্থ থেকে মব ভায়োলেন্সের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এর পেছনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে নির্বাচন প্রলম্বিত করার চিন্তাও থাকতে পারে।”
এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, মব ভায়োলেন্স এখন শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার কৌশল নয়, বরং সামাজিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হয়ে উঠছে। নারী নির্যাতন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ—এসব ঘটনাও মবের মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা হচ্ছে, যার পরিণতি ভয়াবহ।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক দণ্ডমুন্ডের কর্তা হওয়ায় দলগুলোর অপব্যবহার, প্রশাসনের দুর্বলতা এবং সামাজিক অস্থিরতা—এসব একত্রে একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে যেখানে মব হয়ে উঠছে ‘চুপ থাকা জনতার আওয়াজ’। অথচ এই আওয়াজে নেই ন্যায়বিচার, নেই মানবতা।
রাজনৈতিক দলগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত মব ভায়োলেন্সকে ‘প্রতিক্রিয়ার ফল’ বলে ব্যাখ্যা দিয়ে এর দায় এড়ানোর চেষ্টা করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি থামবে না—বরং আরও ছড়িয়ে পড়বে। প্রতিহিংসার রাজনীতির জালে এই দেশ বারবার আবর্তিত হচ্ছে হিংসার এক চক্রে, যেখান থেকে মুক্তির জন্য দরকার শক্তিশালী নৈতিক নেতৃত্ব, কার্যকর প্রশাসন ও দলীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই আশঙ্কা বাড়ছে এই ‘মব রাজনীতি’ আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে। এখন প্রশ্ন একটাই—এই প্রবণতা থামাতে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিই আন্তরিক কিনা? নাকি এই মবই হবে ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার?
আপনার মতামত জানানঃ