রাজধানীর মিরপুরের সেনপাড়া এলাকায় শুক্রবার সকালে ঘটে গেল এক ভয়াবহ নাশকতার ঘটনা। আলিফ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে হামলা চালিয়ে গুলি ছোড়ে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। সকাল ৭টার দিকে ব্যস্ত সড়কে এ ঘটনা ঘটায় মুহূর্তের মধ্যেই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত, যা সাধারণ মানুষকে ভীত–সন্ত্রস্ত করে তুলেছে।
বাসচালক ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিনের মতো ওই সকালে বাসটি যাত্রী নিয়ে সেনপাড়া এলাকায় প্রবেশ করে। হঠাৎ কয়েকজন ব্যক্তি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হাত ইশারায় গাড়ি থামানোর সংকেত দেন। চালক বাস থামানোর পরপরই দুর্বৃত্তরা ঝাঁপিয়ে পড়ে চালক ও তার সহকারীকে বেধড়ক মারধর করে। আহত অবস্থায় তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। আতঙ্কিত যাত্রীরাও তখন দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়েন। এর পরপরই দুর্বৃত্তরা বাসের সামনের কাঁচ লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় বাসটি পুরোপুরি দগ্ধ হয়ে পড়ে।
পুলিশ খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং বাসটি জব্দ করে থানায় নিয়ে যায়। তবে ইতোমধ্যেই বাসের ভেতর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। ঘটনাস্থলে থাকা সাধারণ মানুষের অনেকে বলেন, হঠাৎ করেই সবকিছু ঘটে যায়। গুলি ও আগুনের শব্দে আশপাশে থাকা লোকজন প্রাণভয়ে ছুটোছুটি শুরু করে। অনেকে আবার মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করেন, যা দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
বাস কর্তৃপক্ষের দাবি, এ ঘটনার পেছনে চাঁদাবাজ চক্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারা জানান, কয়েকদিন আগে নেছার নামে এক ব্যক্তি চাঁদা আদায়ের জন্য তাদের স্টাফদের ওপর হামলা চালিয়েছিল এবং গুরুতর জখম করেছিল। কর্তৃপক্ষের মতে, আজকের এই অগ্নিসংযোগও সেই ধারাবাহিকতার অংশ হতে পারে। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে আলিফ পরিবহনকে টার্গেট করে নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠী চাঁদার চাপ সৃষ্টি করছে।
অন্যদিকে মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সম্প্রতি বাস কোম্পানি থেকে কিছু কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছিল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের একটি অংশ প্রতিশোধ নিতে এ হামলা চালিয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, “আমরা সব দিক যাচাই-বাছাই করছি। তদন্ত ছাড়া সুনিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এমন ঘটনার পর এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্থানীয়রা বলছেন, রাজধানীর ব্যস্ত এলাকায় দিনের আলোয় এভাবে গুলি ছুড়ে ও বাসে আগুন দেওয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় ব্যর্থতা। এক দোকানদার বলেন, “আমরা প্রতিদিন এখানে ব্যবসা করি। হঠাৎ এভাবে গুলি চলে, বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়—এটা খুবই ভয়ের ব্যাপার। কাল যদি অন্য কোনো বাস বা দোকানে এমন হয়, তখন কী হবে?”
এ ঘটনায় যাত্রীদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ রাজধানীতে বাসে চলাচল করে। তাই যাত্রীদের একাংশ বলছেন, যদি প্রকাশ্যে এভাবে নাশকতা ঘটে, তাহলে সাধারণ মানুষ নিরাপদ বোধ করবে না। এক যাত্রী বলেন, “আমরা কষ্ট করে জীবিকার জন্য প্রতিদিন কাজে যাই। গাড়িতে ওঠার পরও যদি নিশ্চিত থাকতে না পারি, তাহলে কীভাবে চলব?”
ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, বাসটির সামনের অংশ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে। মানুষজন বিস্মিত ও আতঙ্কিত হয়ে ভিডিও করছেন। অনেকে কমেন্টে লিখেছেন, রাজধানীতে এভাবে নাশকতা চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়বে। অনেকে আবার পুলিশের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একজন মন্তব্য করেছেন, “সবকিছু শেষ হওয়ার পর পুলিশ আসে। আগে প্রতিরোধ করার উদ্যোগ কোথায়?”
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর পরিবহন খাত দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। চাঁদাবাজি, শ্রমিক অসন্তোষ, ভাড়া নিয়ে বিরোধ, এবং মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব সব মিলিয়ে একটি অস্থির পরিবেশ তৈরি করেছে। সেনপাড়ার আজকের এই ঘটনা তারই বহিঃপ্রকাশ। তারা মনে করেন, এ ধরনের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের অরাজকতা দেখা দিতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। পুলিশ বলছে, এটি হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং সুপরিকল্পিত হামলা। আর সেই পরিকল্পনায় একাধিক ব্যক্তি জড়িত ছিল বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকেও ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। তারা বলেছেন, আলিফ পরিবহনের মতো বড় কোম্পানিকে এভাবে টার্গেট করে আগুন দেওয়া দেশের পরিবহন খাতের জন্য এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। তারা দ্রুত দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেছেন।
এমন ঘটনার জেরে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, রাজধানীর রাস্তায় তারা আসলে কতটা নিরাপদ। প্রতিদিন সকাল-বিকেলে লাখো মানুষ বাসে চড়ে কর্মস্থল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যান। যদি চলন্ত গাড়িকে লক্ষ্য করে প্রকাশ্যে গুলি ছোড়া যায়, তবে আগামী দিনে বড় ধরনের ট্র্যাজেডি ঘটতে কতটা সময় লাগবে?
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক যুবক বলেন, “আমি বাসটার পেছনে বাইক চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি কিছু লোক দৌড়ে গিয়ে চালককে মারছে। পরে হঠাৎ গুলি চলল। আমি দ্রুত বাইক ঘুরিয়ে অন্য রাস্তায় চলে যাই। না হলে হয়তো বড় কিছু হয়ে যেত।”
সব মিলিয়ে মিরপুর সেনপাড়ার এই ঘটনা রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। চাঁদাবাজি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নাকি অন্য কোনো গোপন উদ্দেশ্য—সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে দিনের আলোয় সবার সামনে প্রকাশ্যে বাসে গুলি ছোড়া ও আগুন ধরানো নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি পরিকল্পিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এখন সবার দৃষ্টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে—তারা কত দ্রুত দোষীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে, সেটিই নির্ধারণ করবে রাজধানীর সাধারণ মানুষ আবার কতটা নিরাপদ বোধ করবে।
আপনার মতামত জানানঃ