বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন দীর্ঘদিন ধরেই নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোথাও অবকাঠামোর ঘাটতি, কোথাও শিক্ষক সংকট, কোথাও আবার রাজনৈতিক প্রভাব আর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ প্রায়ই জটিল হয়ে পড়ে। সম্প্রতি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ভূটিয়ারকোনা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর এ নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা শুরু হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, অধ্যক্ষ গোলাম মোহাম্মদকে কয়েকজন ব্যক্তি ধাক্কাতে ধাক্কাতে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিচ্ছেন। একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে এভাবে অপদস্থ করার দৃশ্য শুধু স্থানীয় মানুষকে নয়, সাধারণ নাগরিককেও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়তেই অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শিক্ষককে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড, অথচ এই মেরুদণ্ডকেই যখন প্রকাশ্যে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হয়, তখন গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভাইরাল ভিডিওটিতে দেখা যায়, শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে কয়েকজন ব্যক্তি অধ্যক্ষকে জোর করে বের করে দিচ্ছেন। সেসময় আশেপাশে উপস্থিত কয়েকজন নারী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের চোখে-মুখে বিস্ময় ধরা পড়ে। স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, যিনি সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অধ্যক্ষকে ধাক্কা দিচ্ছিলেন তিনি সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এই তথ্য পুরো ঘটনাকে আরও গুরুতর করে তোলে, কারণ একজন শিক্ষক যখন আরেকজন শিক্ষকের প্রতি শারীরিকভাবে এমন আচরণ করেন তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশের অবনতির চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অধ্যক্ষ গোলাম মোহাম্মদ থানায় দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করেন, তাকে প্রথমে গালিগালাজ করা হয়, পরে কিল-ঘুষি মেরে আহত করা হয় এবং তারপর ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দেওয়া হয়। তার দাবি, শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত লেগেছে এবং স্থানীয় মানুষের বাধা দেওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও হামলাকারীরা থামেনি। এমনকি উপস্থিত লোকজনকেও স্কুলে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছিল বলে তিনি অভিযোগ করেন।
এই ঘটনার পর স্থানীয় মানুষ ও অভিভাবকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা দ্রুত মানববন্ধন ও বিক্ষোভের আয়োজন করেন। তাদের দাবি, শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার মতো ঘটনার ন্যায্য বিচার হোক এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অভিভাবকদের অনেকে বলেছেন, সন্তানরা শিক্ষকদের কাছ থেকে শুধু পাঠই শিখে না, তারা শিখে আচরণ, নৈতিকতা, মূল্যবোধও। অথচ যখন একজন শিক্ষক নিজেই প্রকাশ্যে অপমানিত হন, তখন শিক্ষার্থীরা কী বার্তা পাবে? শিক্ষার্থীদের চোখের সামনে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাদের মনে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ক্ষুণ্ন হয়, আর দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়তে পারে তাদের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠনে।
তবে পুরো বিষয়টি শুধু একটি আকস্মিক মারধর বা অপমানের ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। গোলাম মোহাম্মদ দাবি করেন, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ থেকেই দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। নির্বাচনে ভোট সমান হয়ে যাওয়ায় কমিটি গঠন সম্ভব হয়নি। সেই সময় থেকে কিছু শিক্ষক ও স্থানীয় ব্যক্তি তার ওপর দায় চাপিয়ে নানা অভিযোগ তুলতে থাকেন। তিনি বলেন, এর পর থেকে ধীরে ধীরে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা প্রকাশ্যে হামলা ও অপমানের মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ নেয়। অন্যদিকে নতুন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাজেদুল ইসলাম দাবি করেন, গোলাম মোহাম্মদের বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে জমা হয়েছে এবং সেগুলো তদন্তাধীন। তার মতে, গোলাম মোহাম্মদ একরোখা স্বভাবের এবং নিয়মকানুন মানতে চান না। ফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং স্থানীয় মানুষও তাকে আর চাইছিল না। তিনি আরও বলেন, গোলাম মোহাম্মদ যদি সত্যিই নির্দোষ হতেন তাহলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এবং অভিযোগগুলোর নিষ্পত্তি করে তবেই স্কুলে ফিরতেন। কিন্তু তিনি তা না করে জোর করে প্রতিষ্ঠানে আসতে চাইছিলেন, যা অশান্তির সৃষ্টি করেছিল।
এই অবস্থায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আঞ্জুমান আরা বেগম স্বীকার করেছেন, হেনস্তার ঘটনাটি সত্য এবং তদন্ত চলছে। গৌরীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অভিযোগ আদালতে পাঠানো হয়েছে এবং আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে স্থানীয় মানুষ মনে করছেন, ভিডিওতে প্রমাণ থাকার পরও সরাসরি ব্যবস্থা না নেওয়া প্রশাসনের ব্যর্থতা। অনেকেই বলছেন, শিক্ষককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার মতো ঘটনায় পুলিশের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। আদালতের নির্দেশনার অপেক্ষায় থেকে পরিস্থিতি জটিল করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
রাজনীতির প্রভাবও এ ঘটনার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন অনেকে। স্থানীয় সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত দুই পক্ষ এই ঘটনাকে প্রভাবিত করেছে। একটি পক্ষ গোলাম মোহাম্মদকে সমর্থন করছে, অন্য পক্ষ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষাদানের জায়গার বদলে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব নতুন নয়। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, ম্যানেজিং কমিটি গঠন—সব ক্ষেত্রেই রাজনীতির ছায়া দীর্ঘদিন ধরেই বিস্তৃত। এর ফল ভোগ করছে শিক্ষকরা নিজেরা, আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষকের মর্যাদা যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন তা শুধু একটি পেশার সঙ্কট নয়, বরং পুরো সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সঙ্কট। একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে অপমান করা মানে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছে বার্তা দেওয়া যে জ্ঞান ও নৈতিকতার প্রতীক হয়েও শিক্ষক নিরাপদ নন। এটি একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। অভিভাবকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এখন যদি শিক্ষকের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়, তাহলে সন্তানরা কীভাবে শিক্ষার পরিবেশে বেড়ে উঠবে?
ঘটনার পরবর্তী ধাপেও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। এলাকায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। প্রশাসন বলছে, তদন্ত চলছে এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এই তদন্তের দীর্ঘসূত্রতা ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির প্রভাব হ্রাস করতে হবে, শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশাসনিক পদায়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে হবে এবং শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
গৌরীপুরের এই ঘটনাটি কেবল একটি কলেজের ঘটনা নয়, বরং গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি সতর্ক সংকেত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি সত্যিই শিক্ষার জায়গা হিসেবে টিকে থাকতে চায়, তবে সেখানে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক বিভাজন বা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জায়গা থাকা চলবে না। শিক্ষকরা যদি একে অপরকে অপমান করেন, প্রশাসন যদি নীরব থাকে এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা যদি সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করে, তবে শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা শুধু বই নয়, বাস্তব জীবন থেকেও ভুল বার্তা পাবে।
অধ্যক্ষ গোলাম মোহাম্মদকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ও লজ্জাজনক। এটি প্রমাণ করে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হলো, শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। যারা হামলায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে। আর এর প্রভাব পড়বে কেবল শিক্ষক বা প্রশাসনের ওপর নয়, সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীদের মনে, তাদের পড়াশোনার পরিবেশে এবং গোটা জাতির ভবিষ্যতের ওপর।
শিক্ষা কেবল পাঠ্যপুস্তকের বিষয় নয়, এটি চরিত্র গঠন ও নৈতিকতারও শিক্ষা। আর সেই শিক্ষার কেন্দ্রে যিনি থাকেন তিনি হলেন শিক্ষক। তাই শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে গোটা শিক্ষার পরিবেশকে রক্ষা করা। গৌরীপুরের ঘটনার মাধ্যমে যে বার্তা পাওয়া গেল, তা হলো এখনই ব্যবস্থা না নিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা ও অবিশ্বাস আরও বাড়বে। আর একটি জাতি হিসেবে আমরা যদি সত্যিই শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে চাই, তবে এই সমস্যার দ্রুত সমাধান করতেই হবে।
আপনার মতামত জানানঃ