পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লায় দিনদিন ওজন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি বিধি লঙ্ঘন মাদক সেবন ও বিক্রি ইত্যাদি হেন অপকর্ম নেই যা পুলিশের নামের পাশে নেই। সন্ত্রাসীদের চেয়েও যেন ভয়াবহরুপে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। জনগণের বন্ধু বলা হলেও বাস্তবিক অর্থে পুলিশ যেন তার বিপরীত। সন্ত্রাসী অপকর্মে নিজেদের জড়িয়ে পড়া ছাড়াও সন্ত্রাসী ও আসামিদের প্রশ্রয় দেওয়ারও অনেক অভিযোগ রয়েছে। এমনকি থানায় বাদীর মামলায় স্থানীয় প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তির নাম থাকলেও তাতে যেন পুলিশের নিজেদেরই নাম রয়ে গেছে এমন করে বিভিন্ন ফন্দি কৌশল করে মামলা না নিতে অথবা বিভিন্ন পরিবর্তনে নিজেদের ভূমিকা শক্ত করে রাখেন। এবার খবর পাওয়া গেলো, বাদীর এজাহার বদলে দেওয়ার অভিযোগে এক ওসির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিনি রাজশাহীর পুঠিয়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাকিল উদ্দীন আহমেদ। গতকাল রবিবার(২৪ জানু) দুদকের সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ে এ মামলা দায়ের হয়। দুদকের সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিন মামলাটি দায়ের করেছেন।
পুলিশ পরিদর্শক সাকিল উদ্দীন আহমেদ বর্তমানে পুলিশের সিলেট রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ে সংযুক্ত আছেন। তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দীন আহমেদ শিমুল তার ভাই। এজাহার পরিবর্তনের বিষয়টি ধরা পড়ার পর ওসি সাকিলকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিলেট রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়।
দুদকের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, নূরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি পুঠিয়া থানার সড়ক ও পরিবহন মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে তিনি আবারও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সর্বোচ্চ ভোট পান। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ফল পরিবর্তন করে আবদুর রহমান ওরফে পটোল নামের এক ব্যক্তিকে সাধারণ সম্পাদক পদে বিজয়ী ঘোষণা করে। এ নিয়ে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ করে নূরুল ইসলামসহ তিনজন বাদী হয়ে মামলা করেন। এরপর থেকে আবদুর রহমান ও তার সহযোগীরা নূরুল ইসলামকে বিভিন্নভাবে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছিলেন। ২০১৯ সালের ১০ জুন থেকে নূরুল ইসলামের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না।
পরদিন সকালে পুঠিয়ার একটি ইটভাটায় নূরুল ইসলামের লাশ পাওয়া যায়। এ নিয়ে সেদিনই তার মেয়ে নিগার সুলতানা আটজনের নাম উল্লেখ করে পুঠিয়া থানার তৎকালীন ওসিকে একটি এজাহার দেন। সেই এজাহারে শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে পুঠিয়ার ওসির অবৈধ হস্তক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। এ কারণে ওসি সাকিল উদ্দীন আহমেদ এজাহারটি রেকর্ড না করে নিগার সুলতানাকে তা সংশোধন করতে বলেন। নিগার সুলতানা ওসির বিষয়টি বাদ দিয়ে পুনরায় থানায় এজাহার দাখিল করেন। তখন ওসি এজাহারটি গ্রহণ করেন এবং কিছু সাদা কাগজে নিগার সুলতানার স্বাক্ষর নিয়ে তাকে চলে যেতে বলেন।
পরবর্তী সময়ে নিগার সুলতানা পুঠিয়া থানা থেকে এজাহার ও মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর কপি সংগ্রহ করে দেখেন, প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে আসামিদের নাম-ঠিকানা লেখার কলামে ‘অজ্ঞাতনামা’ লেখা আছে। আবার তার উল্লেখ করা আটজন আসামির পরিবর্তে সেখানে ছয়জনের নাম রয়েছে। অথচ তিনি পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানাসহ আটজনকে আসামি করেছিলেন। ওসি সাকিল এসব পরিবর্তন করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
নিগার সুলতানা এই বিতর্কিত এজাহারের বিরোধিতা করে হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট রাজশাহীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা দেন। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান তালুকদার বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে ওসির কারসাজির বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেন। এর ভিত্তিতে হাইকোর্ট ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর ওসি সাকিলকে অভিযুক্ত করে একটি রায় দেন। সাকিল উদ্দীন এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন।
২০২০ সালের ১ মার্চ হাইকোর্ট তার আপিলটি খারিজ করে দুদককে নিয়মিত মামলা করার জন্য নির্দেশনা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিন বিধি অনুযায়ী অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ করে সদর দপ্তরে নথি পাঠান। ১৮ জানুয়ারি সদর দপ্তর থেকে মামলা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ওসির বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে- ওসি সাকিলের এজাহার পরিবর্তনের বিষয়টি পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলের প্রবিধান ২৪৩ ও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তিনি দণ্ডবিধির ১৬৬/১৬৭/২১৭/২১৮ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হলো। তদন্তকালে এসব অপরাধের সঙ্গে আর কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে দুদকের সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিন বলেন, ‘দুদকের তদন্তে পুঠিয়ার নূরুল ইসলাম হত্যার এজাহারে আসামির নাম ও বিবরণে পরিবর্তেনের প্রমাণ মিলেছে। এরপর ওসি সাকিল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত হয়। ওসি সাকিল কারসাজি করে এজাহারে আটজনের বিরুদ্ধে ছয়জনকে আসামি এবং বর্ণনার পরিবর্তন আনেন।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আর্থিক অথবা অন্যকোনো সুবিধার বিনিময়ে ওসি এই কারসাজি করেছিলেন। নিজেকে থানার সর্বৈভ ভাবা ওসি ভাবতে পারেননি মামলা এতদূর গড়াবে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত করলে এমন আরো অভিযোগ পাওয়া যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, থানার কর্তাব্যক্তির কারসাজির কারণে অনেক মামলাই তার সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। আর এমনও না যে থানার লোকদের সহযোগিতা নিয়ে আসামিরা পার পাওয়ার এটাই একমাত্র অভিযোগ। দেশের প্রায় প্রতিটা থানাতেই সন্ত্রাসী ও আসামিদের আশ্রয় দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে। তারা মনে করেন, স্থানীয় প্রভাবশালী যারা স্থানীয় অনেক অপকর্ম অপরাধের হোতা, তাদের সাথে থানা পুলিশের এক অলৌকিক সম্পর্ক থাকে যার সুবাধে অপরাধীরা অপরাধ করতে পিছপা হয় না। পুলিশের সহযোগিতায় দেশের অধিকাংশ অপরাধ কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয় বলে মনে করেন তারা। এসব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে তারা জানান, কেবল বদলি প্রত্যাহার বআ সাস্পেন্ডের মধ্যে অপরাধী পুলিশের শাস্তি সীমাবদ্ধ থাকে বলে দেশের থানা পুলিশ এখনো অপরাধীদের প্রশ্রয় দিয়ে থাকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ