কবির হোসেন : করোনার প্রথম ঢেউয়ে যখন গোটা বিশ্ব নাকানিচুবানি খাচ্ছিল, তখন জাতিসংঘ ও কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ধারণা করেছিল, জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশে করোনার ঢেউয়ে প্রায় বিশ লাখ মানুষের প্রাণহানিসহ ভয়ানক বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণের তখন কোনো সরঞ্জামাদি ছিল না, পরিকল্পনাও ছিল না তেমন, দিশেহারার মতো হাল ছেড়ে দিলেও জাতিসংঘসহ কারো গণনাই বাস্তবে ফলেনি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়েও আন্তর্জাতিকসহ দেশীয় বিশেষজ্ঞরাও ধারণা করেছিলেন করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বুঝি বাংলাদেশ ডুবলো। যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন ধরন শনাক্ত এবং বাংলাদেশে আরো ৩০ ধরনের নতুন করোনা শনাক্তে উক্ত ভাবনাকে আরো উস্কে দিয়েছিল। জনমনেও ফিরে আসে পূর্বেকার চেয়ে আরো তীব্র আতঙ্ক। কিন্তু এবারও বুঝি করোনার শক্ত দাঁত ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে। এর পেছনের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের মানুষের হার্ড ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে, শুরুর অপেক্ষায় আছে আরো অনেক দেশ। হয়তো এমাসের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে। এদেশেও আগামি ২৭ তারিখ থেকে ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। হয়তো আগামি মাসের মাঝামাঝিতে গণহারে ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হবে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা করার তারিখ যতই এগিয়ে আসছে, দেশে পরীক্ষিত আক্রান্তের সংখ্যা ততই কমে যাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের ভূমিকার চেয়ে করোনার ক্রমশ দুর্বল হয়ে ওঠার কিংবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্রমশ বৃদ্ধির কারণকে প্রাধান্য দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। ভ্যাকসিন মানুষের দেহে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সাহায্য করবে। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইতোমধ্যেই দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের দেহে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। উপরন্তু বিগত তিনদিন ধরে টেস্টের জন্য নমুনা দেওয়া রোগীদের মধ্যে মাত্র ৫% রোগী করোনাভাইরাস পজিটিভ।
স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে টেস্টের জন্য নমুনা দেওয়া রোগীদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০% বা তার বেশি। ৫ সেপ্টেম্বর সংক্রমণের হার ছিল ১৫% এর বেশি। তবে এরপর থেকে তা নীচে নামতে শুরু করে। নভেম্বরের শেষের দিকে সংক্রমণের হার আবার ১৫% ছুঁয়ে যায় এবং ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়তেই থাকে। ৭ ডিসেম্বরের পর সংক্রমণের হার নিম্নগামী হতে হতে ১০% এ এসে নামে যা এপ্রিলের পর সবচেয়ে কম ছিল। ৬ জানুয়ারি থেকে তা আরও কমে ৪%-৬% এসে দাড়ায় (সূত্র-ঢাকা ট্রিবিউন)। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হারের নিম্নগামীতা দেখে বোঝা যাচ্ছে দেশে মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে।
এদিকে ডিজিএইচএস এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সংক্রামিত লোকের সংখ্যা আরোগ্য লাভকারীদের সংখ্যার মধ্যে খুব কম ব্যবধান রয়েছে। গত আড়াই মাসে প্রায় ১১৯,৬৬১ জন সংক্রামিত হয়েছে এবং প্রায় ১৪৭,৮৩৫ জন আরোগ্য লাভ করেছে। ডিজিএইচএসের তথ্য অনুসারে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫৩০,২৭১ জন আক্রান্তের ভেতর প্রায় ৮৯.৫৯% মানুষ আরোগ্য লাভ করেছে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এই হার ছিল প্রায় ৭৯.৬৪%। (সূত্র-ঢাকা ট্রিবিউন)
গত সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, “করোনা মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। সবাই ভেবেছিল কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় তরঙ্গ বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারে। তবে মনে হয় বাংলাদেশে দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রভাব পড়েনি।”
ভাইরাসবিদ নজরুল ইসলাম ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “শীতকালে বাংলাদেশে চার ধরনের ভাইরাস সংত্রমিত করে। ইনফ্লুয়েঞ্জা এ ভাইরাস, প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা ৩, শ্বাসযন্ত্রের সিনসিটিয়াল ভাইরাস এবং রাইনোভাইরাস। যখন এই চার ধরণের ভাইরাসের কোন একটি রোগীর দেহে উপস্থিত থাকে তখন সাধারণত শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস রোগীর দেহে প্রবেশ করতে পারে না। আমরা ভেবেছিলাম শীতকালে কোভিড-১৯ আমাদের দেশে মারাত্মক রূপ নেবে। তবে আক্রান্তের হার বাড়ার বদলে প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে যা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।”
এদিকে করোনার প্রথম ঢেউয়ে দেশে সাময়িকের জন্য লকডাউন ঘোষণা করলেও দ্বিতীয় ঢেউয়ে আর সেটা করেনি। তবে প্রথম ঢেউয়ে লকডাউন ঘোষণা করাতেও যে আহামরি কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে সেটাও জোরালোভাবে বলা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাংলাদেশ লকডাউন বইবার মতো শক্তি সামর্থ রাখে না, একইসাথে মানুষের মাঝেও লকডাউন তেমন কোনো শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে পারেনি। করোনার বিধি নিষেধ মানায় দেশের জনগণ অতোটা সিদ্ধহস্তও নয়। উল্টো জীবন জীবিকার ফাঁদে পড়ে থোরাই কেয়ার করেছেন মহামারি। এতদসত্বেও দেশে করোনার মহামারিরুপ অতোটা জোরালো হয়ে আসেনি। কয়েকটা গবেষণাও তখন বলেছিল, লকডাউন মানা লোকজনদের চেয়ে বস্তির গিঞ্জি পরিবেশে থাকা লোকদের করোনা আক্রান্তের হার কম। এর কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞরা এদেশের খেঁটে খাওয়া মানুষের হার্ড ইমিউনিটিকেই এগিয়ে রেখেছেন।
প্রথম ঢেউ দেশকে কাবু করতে পারেনি, তাই সেখান থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে সরকার দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে আরো ভয়ানকরুপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়লেও এবার আর লকডাউন ঘোষণা করেননি। সাধারণ সতকর্কবাণী দিয়ে সবকিছুই স্বাভাবিক রেখেছেন। হাটবাজার, শপিংমল, কারখানা অফিস সবই স্বাভাবিকভাবে চলছে। রাস্তাঘাট হাট বাজারেও আগের মতোই লোকসমাগম হচ্ছে। করোনা বিধি নিষেধ হিসেবে সকলের মাস্ক পরার কথা থাকলেও সেটাও মানছেন না অনেকে। করোনার কারণে কর্মসংস্থান এবং জীবনে সংকট দেখা দেওয়ার কারণে লোকজন জীবন ও জীবিকার তাগিদে পূর্বেকার চেয়ে আরো বেশি গতিতে দৌড়াচ্ছেন এখানে সেখানে। গ্রামাঞ্চলগুলোতে আগে থেকেই করোনার আতঙ্ক থোরাই কেয়ার করে চলে আসছে। এতদসত্বেও দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, আক্রান্তের আরোগ্য সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে করোনা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। আর এর কারণ হিসাবে দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেই সম্ভব বলে মনে করেন।
করোনা ভ্যাকসিনের যে কাজটি করার কথা—দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে কোভিড ভাইরাসকে পরাস্ত করা, এদেশের মানুষের দেহে উৎপন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সেই কাজটিই করছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে করোনা নিয়ে দেশে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল, ঢালাওভাবে আক্রান্তের আশঙ্কা করা হয়েছিল, দিনকে দিন আক্রান্ত সংখ্যা বৃদ্ধির আশঙ্কা ছিল, সেটা না হয়ে ক্রমশ হ্রাস পাওয়াকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এই অভিজ্ঞতা থেকেই সরকারও সমস্ত কিছু স্বাভাবিক রেখেছেন। সরকারি বেসরকারি সমস্ত অফিস কারখানা হাট বাজার সবই খোলা রেখেছেন। তবে এসবের বাইরেও সরকার সতর্কতামূলক অবস্থান হিসাবে কিছু কিছু ক্ষেত্র বন্ধ রেখেছেন। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং লোকজনের জীবন যেন বিপর্যস্থ হয়ে না পড়ে, সেজন্য বিভিন্ন সভা সেমিনার, অনুষ্ঠানাদি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, যেহেতু দেশের লোকজনদের ইতিবাচকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে, দেশে ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রমও শুরু হতে যাচ্ছে, এদিকে করোনাও ধীরে ধীরে নিজের লেজটি গুটিয়ে নিচ্ছে, তাই দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে ইতোমধ্যে দেশের শিক্ষার মান তলানির যেখানে পৌঁছেছে সেখান থেকে তুলে আনতে হবে। তারা মনে করেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার মানকেও ধরে রাখতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা দিলে কোনো দেশেরই অর্থনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক থাকে না বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/২০০১
আপনার মতামত জানানঃ