গাজীপুরে অবস্থিত কাশিমপুর কারাগারের কর্মকর্তাদের অনিয়ম দুর্নীতি আর অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিধি লঙ্গনের ঘটনা দিনদিন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি কারাগারে বন্দী হলমার্ক কেলেঙ্কারির আসামি হলমার্কের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমদকে কারা কর্মকর্তাদের কক্ষে নারীসঙ্গের ব্যবস্থা করে দেয়ার অভিযোগ ওঠে। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হলে এতে কারা কর্তৃপক্ষের অনিয়ম আর দুর্নীতির এক চিত্র উঠে আসে। সম্প্রতি কারা মহাপরিদর্শকের কাছে দেওয়া জ্যেষ্ঠ জেল সুপার রত্না রায়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নারীর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পেতে হল-মার্কের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমদ কাশিমপুর কারাগার-১-এর দুজন কর্মকর্তা ও কয়েকজন কর্মচারীকে ঘুষ দিয়েছিলেন। তবে ভিডিও ফুটেজে জেল সুপার রত্না রায়ের সংশ্লিষ্টতা দেখা গেলেও প্রতিবেদনে নিজের কোনো দায় বা অবহেলার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
১৪ জানুয়ারি কারা মহাপরিদর্শকের কাছে দেওয়া জ্যেষ্ঠ জেল সুপার রত্না রায়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তুষার নারী সঙ্গ পেতে কারাগারের জেলারকে ১ লাখ, ডেপুটি জেলারকে ২৫ হাজার এবং সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টর, গেট সহকারী প্রধান কারারক্ষীকে ৫ হাজার টাকা করে ঘুষ দিয়েছিলেন। তবে স্বপ্না রায় নিজেকে আড়াল করে কারা মহাপরিদর্শকের নিকট এই প্রতিবেদন জমা দেন।
তবে জেল সুপার রত্না প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ঘটনাটি সম্পূর্ণভাবে তার অগোচরে ও গোপনে হয়েছে। কারাগারের গেটে জেলারই তাদের কারাগারে প্রবেশের অনুমতি দেন এবং ডেপুটি জেলার তাদের রিসিভ করেন, যা সিসিটিভি ফুটেজে রয়েছে। সামগ্রিক বিষয়টি ওয়াকিটকির মাধ্যমে না বলে গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে মুঠোফোনের মাধ্যমে হওয়ায় কেউ জানতে পারেনি। তার দাবি, তাকে না জানাতেই এসব করা হয়েছে।
অথচ ভাইরাল হওয়া সিসি ক্যামেরার ওই ভিডিওতে দেখা যায়, অন্য দুই যুবকের সঙ্গে ওই নারী করাফটক পেরিয়ে অফিস কক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সময় তখন দুপুর ১২টা ৫৬ মিনিট। এর পর কাশিমপুর কারাগার-১-এর ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন ও সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায় ওই নারীকে গ্রহণ করছেন। ওই নারীর গায়ে বেগুনি রঙের সালোয়ার-কামিজ ও মুখে মাস্ক পরা।
প্রতিবেদনে রত্না রায় ওই দিনের ঘটনার জন্য জেলার নূর মোহাম্মদ মৃধাকে প্রধানত দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, জেলার নূর মোহাম্মদ মৃধার অনুমতি নিয়ে পুরো ঘটনার সঙ্গে কাশিমপুর কারাগারের ডেপুটি জেলার মো. সাকলায়েন ছিলেন। তিনি বলেন, ওই দিন দায়িত্ব পালনরত ডেপুটি জেলার ও কারারক্ষীদের জবানবন্দি নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। তবে জেলারের জবানবন্দি নেননি। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে রত্না রায় বলেন, যেহেতু পুরো ঘটনা জেলারের তত্ত্বাবধানে সংঘটিত হয়েছে, তাই জেলারকে না জানিয়ে ওই দিন যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।
অবশ্য জেলার নূর মোহাম্মদ মৃধা তার বিষয়ে জেল সুপারের অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি মাত্র চার মাস আগে এ কারাগারের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, জেল সুপারের নির্দেশেই তাদের দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন। তাদের কারাগারে ঢোকার সময় জেল সুপার কারাগারের অফিসেই ছিলেন। তিনি ২০ মিনিট পর বের হয়ে যান। ওই প্রতিষ্ঠানের পরিবারের সবার সঙ্গেই জেল সুপারের সখ্য রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ভাইরাল হওয়া সিসি ক্যামেরার ওই ভিডিওতে আরো দেখা যায় যে, অনেকটা সাহেবি ভক্তিতে কালো টি-শার্ট ও কালো রঙের প্যান্ট পরা তুষার কারাগার থেকে ফটকের কাছে বাম পাশের একটি কক্ষে ঢুকে পড়েন। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই নারীও ঢুকে পড়েন পাশের কক্ষে। বেরিয়ে যান সাকলায়েন। আট মিনিট পর ফেরেন তুষারকে নিয়ে। ১০ মিনিট পর অফিস ছাড়েন, বেরিয়ে যান সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায়। কিছু সময় তারা দু’জন ওই কক্ষে কাটানোর পর বেরিয়ে আসেন। কারাগারের কর্মচারী ও নিরাপত্তা কর্মীদের সেখানে দেখা যায়। দু’জন হেঁটে বের হওয়ার সময় তুষার ওই নারীকে একবার প্রকাশ্যে জড়িয়েও ধরেন। এর পর আবার ওই কক্ষে ঢুকে পড়েন দু’জন। কড়া নিরাপত্তা বাইরে। সময় কাটান পৌনে এক ঘণ্টা। কারাগারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, এটা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। শুধু এ অংশই নয়, অনেক কিছুই ধরা পড়েনি। সাড়ে ১২টার দিকে ওই নারী ঢোকেন করাগারে, বেরিয়ে যান সাড়ে ৫টার দিকে- এমন তথ্য দিয়েছেন করাগারের একাধিক কর্তা। করাগারের ভেতরে এমন তুঘলকি কাণ্ড দেখে হতবাক অনেকেই। কারাগারে কর্মরত কর্তারাই বলছেন, এটা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময় ছাড়া সম্ভব হয়নি। দোষী যেই হোক, তার শাস্তি চাচ্ছেন সহকর্মীরা।
ভিডিও ফুটেজে জেল সুপারের ভূমিকা প্রত্যক্ষ করা গেলেও জেল সুপার রত্না রায় তার দেওয়া প্রতিবেদনে নিজেকে পরোক্ষ করে হলেও কোথাও রাখেননি। নিজেকে একদম নির্দোষ করে রাখার পেছনে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজের সংশ্লিষ্টতা থাকা সত্বেও নিজেকে উহ্য রেখে প্রতিবেদন দেওয়া থেকে প্রমাণিত হয় যে প্রতিবেদন নির্ভুল নয়। তারা মনে করেন, দোষীর হাতে বিচারের ঝাণ্ডা থাকলে এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সংশ্লিষ্ট দোষী সকলকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার কথা বললেও রাঘব বোয়ালরা এর আওতাভুক্ত হবেন বলে মনে করেন না সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, জেল সুপার রত্না রায়ের এমন গাঁ বাঁচানো প্রতিবেদন থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রতিবেদনে আরো কারো না কারো গাঁ বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী সকলকে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ